নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সরকারও নিশ্চয় তা–ই চায়। সাধারণত সরকারের অনুরোধ পাওয়ার পর কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, সরকারের সম্মতি আছে ধরে নিয়েই জাতীয় নির্বাচনের সাফল্যে উৎফুল্ল কমিশন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজন পুরো স্থানীয় সরকারপদ্ধতির অর্থবহ ও আমূল সংস্কার। সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে নির্বাচন শেষ করে ফেললে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সব সংস্কার আটকে যাবে। কারণ, বর্তমান উপজেলা পরিষদব্যবস্থায় নানা অসংগতি রয়েছে। এসব অসংগতি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন না করে শুধু নির্বাচন করলে আবারও জাতিকে একটি বিকলাঙ্গ উপজেলা পরিষদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে যেসব বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে, সে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় পরিষদগুলোর আইন সংশোধন প্রয়োজন। তাই বিদ্যমান আইন সংশোধন করে চলতি বছরের শেষ প্রান্তে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ঘোষিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কয়েক মাস পিছিয়ে আইনগত সংস্কারগুলো শেষ করার অনুরোধ করি।
আইনের সংশোধন কেন ও কোথায় প্রয়োজন এবং কীভাবে অল্প ব্যয়ে সহজে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন একটি একক তফসিলে করা যায়, এসব বিষয়ে একটি প্রবন্ধ গত ২৫ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে যেভাবে পাঁচ বা সাতটি পৃথক ও পরস্পর সম্পর্কহীন আইনে বহুস্তরীয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়, বিশ্বে এ নজির বিরল। এ দেশে একটি সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের পুরো সময় বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হতে থাকে। পাঁচটি নির্বাচনের প্রতিটির জন্য জাতি দুই মাস সময় করে প্রায় ১০ মাস সময় নানা উত্তাপ-উত্তেজনার মধ্যে অতিবাহিত করে এবং সারা দেশের প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। অন্য দূরদেশের দিকে না তাকিয়ে শুধু ভারতের দিকে তাকালেও দেখতে পাব যে তারা একটি একক তফসিলে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। অন্য একটি তফসিলে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ করে। দুটি নির্বাচন করার কারণ তাদের গ্রামীণ ও নগর স্থানীয় সরকার দুটি পৃথক মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা একই তফসিলে সব কটি নির্বাচন করতে পারি। তার জন্য বিদ্যমান আইনের কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন পড়বে। শুধু নির্বাচনের জন্য আইনের সংশোধন প্রয়োজন তা নয়, কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্যও এ সংস্কার ও সংশোধনগুলো দীর্ঘদিনের ফেলে রাখা বিষয়। এ সরকার এই সময়ে এ কাজে হাত না দিলে ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় কোনো সংস্কার হবে তা আর আশা করা যায় না। পাঁচ বছরের সরকারের প্রথম ছয় মাসে সংস্কারের এ কাজগুলো শেষ করা সম্ভব এবং তারপর সরকার বাকি চার বছর এদের নিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক, জনজবাবদিহিমূলক ও প্রাণবন্ত করতে হলে সংস্কার প্যাকেজে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। ১. দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামোকে রাষ্ট্রপতিশাসিত কাঠামোর বদলে সংসদীয় পদ্ধতির কাঠামোয় রূপান্তরিত করতে হবে। ২. পাঁচটি পৃথক ও পারস্পরিক সম্পর্কহীন আইনের পরিবর্তে একটি সমন্বিত, একক ও অভিন্ন ফ্রেমওয়ার্ক আইনের (Integrated Framework Law) অধীনে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করতে হবে এবং ৩. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংসদীয় পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটি পদ্ধতির মিশ্রণে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমানে উপজেলা, ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ের তিনটি পরিষদ তিনভাবে গঠিত। প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন, নির্বাচনপদ্ধতি ও সাংগঠনিক কাঠামোও ভিন্ন। বর্তমান আইনে আন্তপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক অত্যন্ত দুর্বল। সহযোগিতার বদলে রয়েছে আন্তপ্রতিষ্ঠান অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়ায় তাদের কার্যক্রমের শুরু ও শেষ একসঙ্গে হয় না। কার্যকাল শুরুর সঙ্গে অর্থবছরের কোনো সংস্রব থাকে না। তাই একটি একক আইন তৈরি হলে এসব অসামঞ্জস্য চিরতরে দূর করা সম্ভব হবে।
সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে অন্তত ছয়–সাত মাস পিছিয়ে দেওয়া হোক। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নতুন আইন পাস করে এ বছরের শেষ প্রান্তিকে উপজেলা, ইউনিয়ন, জেলা ও পৌরসভা নির্বাচন একটি একক তফসিলে সম্পন্ন করার। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার পঞ্চায়েত আইনগুলো পর্যালোচনা করে দেখুন। সেখানে সরাসরি কোনো মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন না। সবাইকে প্রথমে সংসদের এমপির মতো সদস্য বা কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে হয়। সদস্য বা কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে তাঁদেরই ভোটে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত হন। এভাবে নির্বাচিত প্রতিটি পরিষদ একেকটি সংসদের মতো কাজ করে। নির্বাচন তাদের মতো আমরাও দলীয় প্রতীকে যেহেতু করে থাকি, তাই আমাদের দেশেও সংসদীয় পদ্ধতি চালু হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সরকারি ও বিরোধী দল থাকবে। স্থায়ী কমিটিগুলো তাতে অধিক কার্যকর হবে।
আশা করি প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রিসভা, বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের দুজন মন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন। আর নির্বাচন কমিশনও অন্যান্য দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনপদ্ধতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে এবং সংস্কারের কাজটি শেষ করে সুষ্ঠু ও সুন্দর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে অগ্রসর হবে, এটাই প্রত্যাশিত।
ড. তোফায়েল আহমেদ, রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক। স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ