ভারতে নাগরিকত্বের রাজনীতি ও ছিন্নভিন্ন বাঙালি
ছয়জনে একজন বাদ
আসামে জনসংখ্যা প্রায় সোয়া তিন কোটি। এর মধ্যে ১০ লাখ গত সোমবার চিরতরে নাগরিকত্ব হারালেন। এসব মানুষের নতুন বছর শুরু হলো ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’ পরিচয় নিয়ে। আরও ৩০ লাখ সেখানে বসবাস করছেন অনুরূপ শঙ্কায়। তাঁরাও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় ‘বেনাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে অপেক্ষায় রয়েছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে। আসামজুড়ে প্রায় আড়াই হাজার এনআরসি সেবাকেন্দ্রে এসব আপিল পেশের সর্বশেষ সময় ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর। ভবিষ্যতে সেখানকার ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’-এ এসব আবেদনের ফয়সালা হবে।
যদিও বলা হচ্ছে, এ বছরের জুনের মধ্যে এনআরসির কাজ সমাধা হবে, কিন্তু ৩০ লাখ মানুষের আপিল আবেদন মীমাংসা এই সময়ের মধ্যে করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাড়তি সময় লাগলে বেনাগরিক এই মানুষদের জীবন কীভাবে চলবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আসামজুড়ে বাংলাভাষীদের বড় এক অংশ প্রচণ্ড মানসিক দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী এখন। ‘সমাজ’-এ ইতিমধ্যে তারা নানামুখী চাপের শিকার হয়ে চলেছে। খোদ গুয়াহাটিতে টান টান উত্তেজনা। দূরবর্তী জেলাগুলোর যেসব জায়গায় অল্প সংখ্যায় বাংলাভাষী থাকে, তাদের অবস্থা আরও অনিরাপদ।
এ পর্যন্ত ২০ জনের আত্মহত্যা
এ পরিস্থিতিতে সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে সচেতনভাবে। যাঁরা এনআরসিকালে নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন, তাঁদের দুই থেকে তিন লাখের বিরুদ্ধে অসমিয়ারা নতুন করে নালিশ তুলেছে। এরূপ দুই থেকে তিন লাখ মানুষের পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ হবে। ফলে, পুরোনো ৪০ লাখ বেনাগরিকের সঙ্গে নতুন করে নালিশের শিকার ১০ লাখ মিলে ৫০ লাখের বেশি মানুষ আসামে এখন বেনাগরিক বলা যায়। অর্থাৎ রাজ্যে প্রতি ছয়জন মানুষের মধ্যে একজন নাগরিকত্ব নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় আছেন। স্বভাবত, এই অবস্থা ভারতনিয়ন্ত্রিত এই প্রদেশে এক অমানবিক ও বিস্ফোরক অবস্থা তৈরি করেছে। এমন অপমানকর পরিস্থিতি স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও অনেক বেড়ে গেছে। গত কয়েক মাসে প্রায় ২০ জন বাংলাভাষী আসামে আত্মহত্যা করেছেন, যাঁদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধও রয়েছেন।
৫০ শতাংশ হিন্দু ঠিক, ৪০ শতাংশ মুসলমান বাদ
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একটি জনপদের প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ মানুষকে এভাবে বেনাগরিক করার দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। কাজটিকে ন্যায্যতা দিতেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব বেনাগরিক মানুষের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে অবহিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে শুরু থেকে। প্রাথমিকভাবে বিজেপির চিন্তকেরা ধারণা করেছিলেন, এনআরসি হলে নাগরিকত্বহারা মানুষের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি হবে। তাতে মুসলমানবিদ্বেষী রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। কিন্তু বিপুল সংখ্যায় হিন্দুও খসড়া এনআরসি তালিকায় বাদ পড়ে। অনুমান করা হয়, নাগরিকত্বহারা মানুষদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ বাংলাভাষী হিন্দু এবং ৪০ ভাগ বাঙালি মুসলমান। এ অবস্থায় বিজেপি কৌশল পাল্টায়। তারা বলছে, নাগরিকত্বহারা হিন্দুদের তারা নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করবে দেশটির নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে।
জাতীয় পর্যায়ে বিজেপি দেশটির নাগরিকত্ব আইনকে এখন এমনভাবে সংশোধন করতে চাইছে, যাতে করে এনআরসি থেকে বাদ পড়লেও আসামের হিন্দুরা সেখানে থেকে যেতে পারবে। অন্তত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে বেনাগরিক মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা হবে না। এ সপ্তাহেই লোকসভায় এই সংশোধনী পাস করাতে চাইছে বিজেপি। তাদের সুপারিশকৃত সংশোধনীর সারমর্ম হচ্ছে অন্য দেশের হিন্দুরা ভারতে ছয় বছর বসবাস করলেই নাগরিকত্বের সুযোগ পেতে পারবে, তবে মুসলমানদের জন্য সেই সুযোগ নয়। বিজেপির এরূপ কৌশলের কারণে স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি আসামের বেনাগরিক হিন্দুদের সমর্থন তৈরি হয়েছে। বেনাগরিক হিন্দু-মুসলমান মিলে এনআরসির অমানবিকতার বিরুদ্ধে বাংলাভাষী সমাজ আর আগের মতো দাঁড়াতে পারছে না।
তবে নাগরিকত্ব আইনের আসন্ন সাম্প্রদায়িক সংশোধন নিয়ে বিজেপির সঙ্গে তার অসমিয়া সহযোগী দলগুলোর মতদ্বৈধতা আছে। অসমিয়াদের সবাই মোটামুটি বাঙালিদের বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ। বিজেপি রাজনৈতিকভাবে এদের মিত্র। অসমিয়ারা চাইছে, বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে যাঁদের এনআরসিতে নাম ওঠেনি, তাঁদের সবাইকে ‘ডিটেনশন সেন্টার’-এ ঢোকানো হোক। আসামজুড়ে এ রকম অনেক ডিটেনশন সেন্টার বানানো হয়েছে এনআরসিহীন বাংলাভাষীদের জন্য। সেন্টারগুলো পুরোদস্তুর কারাগারের মতো।
‘বাংলাদেশি’ বানানোর কর্মসূচি
আসামের বাংলাভাষী মানুষদের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত অবস্থার শুরু ১৯৭৯ সাল থেকে। অসমিয়া তরুণেরা ‘বিদেশি হটাও’ আন্দোলনে নামে ওই বছর। তাদের শান্ত করতেই ১৯৮৫ সালে এক চুক্তি হয় এবং এই রাজ্যের অধিবাসীদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে বলা হয়। প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এনআরসি কার্যক্রমে তাদের তথ্য-প্রমাণ দাখিল করলেও ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চূড়ান্ত খসড়া এনআরসিতে দেখা যায়, প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহীন ঘোষণা করা হয়েছে। এসব মানুষকে ৩১ জুলাই থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর মধ্যে পুনরায় তাঁদের আবেদন পেশ করতে বলা হয়। ইতিমধ্যে সেই সময়সীমাও পার হয়েছে।
উদ্যোগটি ছিল অভিনব। কারণ, ভারতের আর কোথাও এরূপ নাগরিকপঞ্জী তৈরির দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। ২০১৩ সালের শেষ দিনগুলোয় এই উদ্যোগের কারিগরি দিক শুরু হয়। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে বিজেপি সরকার তাতে বাড়তি গতি দেয়। সিদ্ধান্ত হয়, যাঁদের কাছে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগে আসামে অবস্থানের প্রমাণপত্র থাকবে, তাঁরাই কেবল নাগরিকত্ব পাবেন। স্থানীয় বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিতেই এনআরসির শর্ত হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে উল্লিখিত তারিখটি নির্ধারণ করা হয়। স্থানীয় দরিদ্র মুসলমান ও হিন্দুরা এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে মুশকিলে পড়েন। কারণ, অনেকের কাছেই নাগরিকত্ব প্রমাণের শর্তমূলক কাগজপত্র সংরক্ষিত ছিল না। অনেকে তাই নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রক্রিয়ায় আবেদনও করতে পারেননি।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকালে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানরা ছিলেন বিজেপির অন্যতম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। চার বছর পর এনআরসি হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও এটা নিয়ে বিজেপি ও তার স্থানীয় সহযোগী দলগুলোর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কাজ পুরোপুরি সচল আছে। বিজেপি এখন আসামের কথিত হিন্দু ও মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’দের আলাদা করতে চায়। ‘সিটিজেনশিপ (সংশোধন) বিলে’র মাধ্যমে বিজেপি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের নির্ধারিত তারিখকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করে বাংলাভাষী হিন্দুদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় দিতে ইচ্ছুক। স্বাভাবিকভাবেই এতে স্থানীয় বাংলাভাষী সমাজের বেনাগরিক মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন বোধ করছেন।
আবার অসমিয়সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীরাও নাগরিকত্ব আইনের আসন্ন সংশোধনের বিপক্ষে। তারা মনে করছেন, এই সংশোধনীকে ব্যবহার করে বাঙালি হিন্দুদের আরও অভিবাসন বাড়বে আসামসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে। তাঁদের এই মনোভাবকে ব্যবহার করে উলফাসহ অসমিয়া গেরিলা সংগঠনগুলো আবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে তৎপর। এতে করে এই অঞ্চলে বাংলাভাষীদের নিরাপত্তাহীনতার বড় জমিন তৈরি হয়েছে নতুন করে। বিজেপি কৌশলে অসমিয়াদের সঙ্গে বাংলাভাষীদের দূরত্ব বাড়ানো ছাড়াও বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে বরাক উপত্যকার নির্বাচনী আসনগুলোয় ভোটের অঙ্ক অনুকূলে নিতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গেও তারা এই ইস্যুকে ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বড় আকারে ব্যবধান তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
উল্লেখ্য, এনআরসি হওয়ার আগে পর্যন্ত আসামে বাংলাভাষীরা ছিল জাতিগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ—প্রায় এক কোটি। আর্থিকভাবেও এই জনগোষ্ঠী ছিল অপেক্ষাকৃত সবল। তাদের এই সংখ্যা-সামর্থ্যই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে তাদের চক্ষুশূল করেছে। বিশেষ করে বিগত কয়েকটি লোকসভা নির্বাচনে আসামে মুসলমান প্রতিনিধিদের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখে বিজেপি তাকে সাম্প্রদায়িক রং দেয়। এভাবেই সেখানে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা গতি দেওয়া হয়। এখন বাংলাভাষীদের প্রায় অর্ধেকই নাগরিকত্বহারা হওয়ায় আসামের রাজনীতির পুরো ছকটিই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেকখানি পাল্টে যেতে পারে। যদিও এখনো স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না, বেনাগরিক মানুষদের কতজন আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন; কিন্তু মে মাসের জাতীয় নির্বাচন বিজেপি ও তার অসমিয়া সহযোগীরা বাংলাভাষী ভোটারদের কোণঠাসা করতে এনআরসি থেকে ব্যাপক বাড়তি সুবিধা নেবেই।
সাম্প্রদায়িকতার সুদিন
আসামের সমাজ এনআরসির রাজনীতিতে চরমভাবে বিভক্ত। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের হীন স্বার্থে আসামের সমাজে বহুদিন থেকে বহুভাবে বিবাদের বীজ বহন করেছে। এই বিভক্তি বাড়াতে বিভিন্ন মহল নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করছে প্রতিনিয়ত। যার সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ হলো যেসব মানুষ এনআরসির খসড়ায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন, তাঁদের দুই থেকে তিন লাখের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে আপত্তি তুলেছে অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু)। আসু এরূপ অভিযোগ তোলার জন্য অসমিয়াদের অনুপ্রাণিতও করছে। শত্রুতাবশতও অনেক বাংলাভাষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠুকে দেওয়া হয়েছে।
এনআরসির খসড়া তালিকায় নাম থাকার পরও অভিযোগ তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে রাজ্যের বরপেটা জেলায়। এখানে বাংলাভাষী মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি। স্পষ্টত, একধরনের সাম্প্রদায়িকতার জায়গা থেকে নতুন অভিযোগগুলো উত্থাপিত হচ্ছে। এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়াতেও পর্দার আড়ালে বেশ সাম্প্রদায়িক ব্যাপার ছিল। এই প্রশাসনিক আয়োজনের মূল কর্মকর্তা প্রতীক হাজেলা বিজেপি পরিবারের পছন্দের মানুষ। আবার সুপ্রিম কোর্টে যে বিচারপতি এই কার্যক্রমকে বিশেষ গতি দিয়েছেন, সেই রঞ্জন গগৈ আসামের মানুষ, যাঁরা প্রথম থেকেই বাঙালিবিরোধী। এ কারণে পুরো কার্যক্রমে ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষের ছাপ অস্পষ্ট নয়।
এদিকে আসামের এনআরসিতে ৪০ থেকে ৫০ লাখ বাংলাভাষী নাগরিকত্ব হারানো মাত্রই মেঘালয়, মণিপুর, ত্রিপুরাসহ সর্বত্র বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ‘বিদেশি’ অভিযোগ উঠছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে বাংলাভাষীদের শিক্ষা, কাজ ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এখন বাড়তি সন্দেহের মুখে পড়তে হচ্ছে। গুয়াহাটি-শিলং রোডে গাড়ি থামিয়ে বাংলাভাষী খোঁজা হচ্ছে। আসাম ছেড়ে কেউ মেঘালয়ে ঢুকছেন কি না, সে বিষয়ে নজরদারি করছে খাসি তরুণেরা। সন্দেহ হলেই যে-কারও কাছে এনআরসির সনদ দেখতে চাওয়া হচ্ছে। ত্রিপুরায় ইতিমধ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরির আবেদন উঠেছে। স্বভাবত ওই সব অঞ্চলের বাঙালিরা অস্থির সময়ের আশঙ্কায় আতঙ্কিত।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক