দেশের মানুষ ভোটের ফলাফলের চমকটা হজম করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই অবস্থায় সংবাদমাধ্যমে পরপর দুই দিন দুটি খবর ছাপা হলো। প্রথম আলো-র প্রথম পৃষ্ঠায় পরপর দুই দিনের শিরোনামেই দেশের রাজনৈতিক অসহায়ত্ব ধরা পড়ে। শুক্রবারের খবর: ‘সরকারে না বিরোধী দলে, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চায় জাতীয় পার্টি’। শনিবারের শিরোনাম: ‘জাপা প্রধান বিরোধী দল, এরশাদ বিরোধী নেতা’।
দুটি প্রতিবেদনই খুঁটিয়ে পড়ে বুঝতে চাইলাম, আইন কার কথায় চলে? সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি বলেছে, স্পিকারের রুলিং মতে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজ অনুযায়ী স্পিকারের সিদ্ধান্ত অবশ্য খেয়ালখুশিনির্ভর বিষয় নয়। তঁার রুলিং সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজসম্মত হতে হবে। আমাদের আইনে একটি বাক্য আছে। আর সেটা হলো ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধি সংঘের নেতা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোটের অংশীদার জাপা। তারা উন্নয়নের রাজনীতির যৌথ অংশীদার।
বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথমে জাতীয় পার্টির একজন মন্ত্রী ও পরে আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। জাপা মন্ত্রী বলেন, তাঁর নিজের ধারণা গোটা নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারের গুণগান গেয়ে এখন বিরোধী দলে বসলে জাপাকে লোকে কী বলবে। ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, বিরোধী দল হতে হলে ২৫ জন লাগে। কমপক্ষে ১০ থাকলে তাকে সংসদীয় অধিসংঘ বলা যাবে। এই ধারণাটি উপমহাদেশীয় সংসদীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন খোন্দকার আবদুল হক। ইউএনডিপির অর্থায়নে তাঁর (প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন) সংসদীয় রীতিনীতি সংক্রান্ত বইটি ২০০১ সালে ছাপা হয়। সংসদীয় রীতিনীতি প্রধানত স্পিকারের রুলিংনির্ভর। ন্যূনতম কতজন হলে বিরোধী দল বলা যাবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো স্পিকার নির্দিষ্ট রুলিং দেননি। ৫৪৫ জনের ভারতের লোকসভায় কমপক্ষে এক–দশমাংশ আসন পেলে ‘সংসদীয় দল’ হিসেবে মর্যাদা পাবে। ৩০ জনের কম হলে সংসদীয় গ্রুপের স্বীকৃতিও মিলবে না। তবে সংসদীয় গ্রুপ বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে না। ১৯৬৯ পর্যন্ত টানা তিনটি লোকসভায় কোনো বিরোধী দল ছিল না। কংগ্রেসের আসনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে চার বছর ধরে ভারতের লোকসভায় স্বীকৃত বিরোধী দল বলে কিছু নেই। তবে বাংলাদেশে একটি শর্ত
পূরণ করলেই হলো। সংখ্যা যা–ই হোক, তাকে ‘সরকারের বিরোধিতাকারী দল’ হতেই হবে। বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে। অন্যদিকে গণফোরামের দুজন যেতে পারেন বলে শুক্রবার রাতে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইঙ্গিত পাই।
বিএনপি সংসদে গেলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিরোধী দলের নেতা ও সুলতান উপনেতা, এটাই বেশি গ্রহণযোগ্য। বিএনপি বয়কট করলে ভিন্নকথা। ১৯৭৩ সালে আতাউর রহমান খান বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। ৩১৫ আসনের (নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১৫ সহ) সেই সংসদে ৩০৭টি ছিল আওয়ামী লীগের। বাকি সদস্যদের প্রয়াত নেতা জিল্লুর রহমান ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ বললে উত্তাপ ছড়ায় সংসদে।
আমরা স্মরণ করাতে চাই যে, ‘সরকারের বিরোধিতাকারী’ পরিচয়দানকারী সাংসদেরা (৫ থেকে ৭ জন) সংসদ ভবনে আলাদা কক্ষ চাইলে স্পিকার তা মঞ্জুর করেছিলেন। ওই কক্ষ বরাদ্দের পরে যে বিতর্ক হয়, তাতে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ওই মন্তব্য করেছিলেন। তবে আতাউর রহমান খান বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কনভেনশনের যে যুক্তি (২৫ জন লাগবে) দেন, তা আইন দ্বারা ডিঙানো চলে। ফলে বিএনপি না এলে গণফোরামই হবে প্রকৃত প্রধান বিরোধী দল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সর্বদা সহাস্যে স্মরণ করতেন যে, বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলতেন, ‘তুই আমার বিরোধী দল।’
এখন যদিও কেউ দিনকে রাত আর রাতকে দিন ভাবতে বাধ্য করাতে পারেন, কিন্তু যে কেউই এটা অন্তত একবাক্যে মানবেন যে, জাপা আর যা–ই হোক, বর্তমান সরকারের বিরোধিতাকারী দল নয়। সুতরাং জাপা এই শর্ত পূরণ করে না। প্রধান বিরোধী দল হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হতে হবে। জাপা এই শর্তটি পূরণ করে। কিন্তু তারা যদি ‘সরকারের বিরোধিতাকারী দল’ না হয়, তাহলে তারা সংখ্যায় কত, সেটা প্রাসঙ্গিকতা হারায়। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীকে যখন বলি, বিএনপি যত কম আসনই পাক, তারাই আইনগতভাবে বিরোধী দল, তখন তিনি দ্রুত ভিন্নমত দেন। বলেন, জাপা ২২টি পাওয়ায় সেটা কি করে হবে?
জাপা কেন বিরোধী দলে—জি এম কাদের গতকাল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সংসদ পরিচালনায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সে কথা বিবেচনা করেই জাতীয় পার্টি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা রাখবে।’ এটা স্পষ্টতই বিরোধী দল হওয়ার আইনি শর্ত পূরণ করে না।
এটা পরিষ্কার যে, নির্বাচনপূর্ব তাড়াহুড়োর মনস্তত্ত্ব থেকে সরকারি দল এখনো বেরোতে পারছে না। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দশম সংসদের মেয়াদ পূরণের সাংবিধানিক শর্ত আছে। কিন্তু তা পূরণের তাড়না এখন কোথায় গেল? একাদশ সংসদ গঠন সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত এরশাদ অপেক্ষা করতে চাননি। বৈধতার দুটি দিক থাকে। একটি রাজনৈতিক অন্যটি আইনগত। এরশাদের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া দুভাবেই অবৈধ। এটা সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমর্থন করে না। এটা সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি সমর্থন করে না। কেউ বলতে পারেন, একাদশ সংসদ গঠনের আগেই এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নিজেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান দিতে পারলেন, কারণ তিনি ভরসা করতে পারেন যে সংসদ থেকে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না।
এরশাদ রাজনীতির খলনায়ক। তিনি বিচিত্ররূপে প্রাসঙ্গিক থাকছেন। কিন্তু যতই ভেলকি দেখান, নূর হোসেনদের রক্তের দাগ তাঁর হাত থেকে মুছে যাবে না। সাবেক ফার্স্ট লেডি মন্ত্রীর মর্যাদায় এখনো বিরোধী দলের নেতা। নিজে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিশেষ দূত থাকছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রধান বিরোধী দল বয়কট করেছে বলে তাদের বিরোধী দলে বসা নিয়ে মানুষ হকচকিত হয়নি। জাপা তখনো কম নাটক করেনি। তখন ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতিটা ছিল। এবারে জোটগতভাবে ভোট করেছে। দেড় শ আসনেও প্রার্থী দেয়নি। তাই দুই পর্বের নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রস্তুতি মৌলিকভাবে আলাদা। জীবনসায়াহ্নে এরশাদ সংসদের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন বিরোধী দলের নেতা হতে রাজি। মুক্তিযোদ্ধা মনজুর হত্যা মামলার আসামি এরশাদ ২০১৯ সালে আমাদের জাতীয় জীবনের নতুন অবতার। আশা করব, স্পিকার আইনি বাধার কারণে তাঁকে মেনে নেবেন না। শর্ত পূরণ না হওয়ায় বিরোধী দলের নেতা ছাড়াই চলার উদাহরণ প্রতিবেশী ভারতে আছে। সুতরাং প্রধান বিরোধী দল বয়কট করলে করবে। কিন্তু সরকারের সমর্থনদানকারী হিসেবে একটি আত্মস্বীকৃত দলের বিতর্কিত নেতাকে ‘বিরোধী দলের নেতা’ হিসেবে আমরা দেখতে চাইব না।
অবশ্য এই লেখাটি ছাপা না হতেই এরশাদ ভোল পাল্টাবেন না, তা বলা যায় না। সমালোচকেরা বলেন, তাঁর নাটাই অন্যত্র। ‘অদৃশ্য ক্রীড়নকের’
পুতুল তিনি। সত্যিই তিনি বিশ্বে পাতানো বিরোধী দলের এক লজ্জাজনক উদাহরণ তৈরি করেছেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি বলেছিলেন, জাপা নির্বাচন না করলে জামায়াত সরকার করবে। সেই জামায়াত নির্বাচনেই অংশ নেয়নি। কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এরশাদের দলকে আমরা সরকারে দেখেছি।
আমরা কিছুতেই সেলিম ও দেলোয়ারের ট্রাকচাপা, শহীদ মিলনের রক্তাক্ত লাশের স্মৃতি ভুলতে পারি না। জেনারেল জিয়া ও খালেদা জিয়ার মতোই এরশাদ জাতির জনকের ঘাতকদের পুনর্বাসনকারী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রানিংমেট করে খুনি ফারুককে রাজনৈতিক বৈধতাদানকারী। তিনি ইদানীং অবশ্য অনুশোচনা করে সরকারি দলের কপট ‘ভক্ত’ হয়েছেন। টানাটানির খেলায় তিনি আর অনাথ বিএনপির দিকে তাকানোরও ফুরসত পান না। কিন্তু সাড়ে নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি মিছিল, প্রতিটি স্লোগানের নিনাদ ছিল, এরশাদের বিচার কর। তাঁর সহযোগীদের বিচার কর। সেই আওয়াজ বাতাসে মিলিয়ে যায়নি।
মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক