ভয়, ভোট আর ভবিষ্যৎ
ধান উঠলে প্রতি মৌসুমে তিনি তাঁর কলের লাঙলের মোটরটি খুলে নৌকায় লাগাতেন। পোস্টারে-ব্যানারে যে নাও এখন উড়ছে, নৌকা তাঁর তেমনই ছিল। ইঞ্জিন লাগিয়ে তিনি সেটাকে আধুনিক বানিয়ে নিতেন।
তারপর ডিজিটাল আধুনিক সেই নৌকা নিয়ে তিনি নদী-খাল বেয়ে প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোতে পৌঁছে যেতেন। একেক এলাকায় কয়েক দিনের জন্য ঘাঁটি গেড়ে নৌকার ইঞ্জিনটি খুলে সেটা দিয়ে কলের ঢেঁকি পাততেন।
ছোট-বড় কৃষকেরা তাঁর কলে ধান ভানিয়ে নিয়ে যেতেন। যাঁর যত ধান, সেই ধানের মাপে ঘরে চাল উঠত। বছরভর দারিদ্র্য হয়তো অনেকেরই ঘুচত না, কিন্তু কষ্টের ধানে পাওয়া চালে মৌসুমি নবান্ন তো আসত। ইঞ্জিনমালিক দরিদ্র মানুষটিরও বছরভর জীবিকার কিছুটা জোগাড় হয়ে যেত।
অভিনব উদ্ভাবক উদ্যমী এই মানুষটির কথা শুনেছিলাম দেশের উত্তরাঞ্চলে, প্রায় এক যুগ আগে। তাঁর খদ্দেরদের মুখে শোনা গল্পটি মনে রয়ে গেছে।
এবারকার নির্বাচনে ভোটপ্রার্থীদের প্রতীকের হিসাব করতে করতে গল্পটা ছবি হয়ে মনে ভাসল। প্রতীকের গোনা-গুনতিতে এবার নৌকা আর ধানের শীষ গা ঘেঁষে পাল্লা দিচ্ছে। ভোটসাগরে গন্তব্য নিশানা করে নৌকা ভেসেছে ২৭২টি। আর ধানের শীষের গোছা বাতাসে দুলছে ২৮২টি।
তবে নৌকা আর ধানকে টেক্কা দিয়েছে হাতপাখা। ভোটের গরমে গ্রীষ্মকালের প্রাণের সখা এবার শীতকালেও দেখা দিয়েছে। পীর সাহেব চরমোনাইয়ের দোয়া মাথায় নিয়ে ভোটের বাজারে ক্রেতা খুঁজছে ২৯৮টি হাতপাখা।
নৌকার অবশ্য আছে ১৭৫টি লাঙ্গলের জোর। আর ওজন মাপার জন্য ধানের শীষের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে এক কুড়ির বেশি দাঁড়িপাল্লা। ডানে-বাঁয়ে আর ইসলামপন্থীতে দলে-জোটে ভূতপূর্ব-অভূতপূর্ব মিতালি আর বিরোধ।
দন্ত্যস-য়ে সন্ত্রাস, সহিংসতা। আর তালব্য শ-য়ে শক্তি। সরকারি-বেসরকারি নানা ব্যাংক জামাই–আদরে অনেক অনেক মহাশক্তিধর মহারথীকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়ে রেখেছে দান হিসেবে। শোধ না করার দায় ধামাচাপা দিয়ে তাঁদের অনেকে বুক ফুলিয়ে নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল ইত্যাদি কার্ড ঝুলিয়ে ভোটারের দরবারে হাজির হয়েছেন।
ঢাকার কারওয়ান বাজারে আমার অন্নদাতা দপ্তরের কাছেই মাসের বেতন তোলার ব্যাংক। ভোটের আগে আগাম বেতন গেছে। হিসাবের টাকা তুলব বলে সেদিন শাকসবজি-বাঁধাকপি থেঁতলানো সবুজ সড়কে পা দিতেই মনে হলো আকাশে অতিথি পাখির ঝাঁক উড়ছে। চোখ তুলে দেখি, মাথার ওপর সারি সারি দড়িতে টাঙানো নৌকার পোস্টারে দমকা হাওয়ার ঝোঁক লেগেছে। সেসব প্রচার-প্রচারণাই পাখির ডানার শব্দ তুলেছে।
ভ-য়ের তিনটি শব্দ মাথায় ঘুরছে—ভয়, ভোট আর ভবিষ্যৎ। আমার বাড়িতে যে মেয়েটি ঠিকা কাজ করেন, তাঁর বাড়ি সুদূর দক্ষিণাঞ্চলের একটি গ্রামে। তাঁর বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই ঢাকায় কাজকর্ম করে খান। মেয়েটি কিছুদিন আগে বলেছিলেন, গ্যাঞ্জামের ভয় না থাকলে গ্রামবাসী দেওর খবর দেবেন। তখন ঢাকাবাসী স্বজনেরা এক দিনের নদীপথ পাড়ি দিয়ে ভোট দিয়ে আসবেন। মেয়েটির এলাকার প্রধান প্রার্থী ফ্রি লঞ্চের ব্যবস্থা করেছেন। গত পরশু মেয়েটি জানালেন, দেওরের ফোন পেয়েছেন। তাঁরা সেদিনই রওনা দিচ্ছেন। মেয়েটি আরও বললেন, দেওর বলেছেন পরিবারের অনেকগুলো ভোট। তাঁরা ভোট না দিলে পরে কোনো দাবি-অনুরোধ নিয়ে নেতা-বিধাতাদের কাছে যাওয়া যাবে না।
সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষটিরও ভোটের দাম অন্য যে কারও ভোটের দামের সমান। মানুষটি হয়তো রাজধানীর ফুটপাতে থাকেন অথবা দেশের কোনো যৌনপল্লিতে শরীর বেচে খান, কিন্তু ভোটের সময় তিনি গণদেবতা। এই ভোটের জোরেই টাঙ্গাইল যৌনপল্লির মেয়েরা বহু বছর আগে নিজেদের জন্য একটি কবরস্থান আদায় করে নিয়েছিলেন।
ভ-য়ের ভয় আর ক-য়ের কৌশল-কারচুপি কোনো জুয়েল আইচ যদি সত্যিই উধাও করে দিতে পারেন, তা হলেই আজ গণদেবতার শক্তির পরীক্ষা হতে পারবে। গণদেবতারা আসলে তো নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের উথাল-পাথাল সাগরে ভাসা-ডোবা গণমানুষ। তাঁরা নিরাপদে-নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করে সন্তানসন্ততি নিয়ে একটু ভালো ভবিষ্যতের আশায় বাঁচেন।
আমার পাড়ার মোড়ে গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির একটি ছোট দোকান আছে। সেদিন দোকানে বসে রং চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মালিক বলছিলেন, তিনি গ্রিন রোডে আরেকটা দোকান নেওয়ার জন্য পয়সাপাতি জমাচ্ছেন। সেই পরিকল্পনাকে ঘিরেই আপাতত তাঁর ভোট-ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। তাঁর কথায়, শেখ হাসিনা নেতা হিসেবে ভালোই। তবে নেত্রীর লোকজন অনেক অপকর্ম করে, তিনি সামাল দিতে পারেন না। আবার বিরুদ্ধপক্ষকে নিয়েও এই দোকানমালিকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে—‘তারা তো সব ক্ষুধার্ত। ১০ বছর কিছু খাইতে পায় নাই। তারা জিতলে তো আগে নিজের পেট ভরাবে।’
আজ গণদেবতার ক্ষমতা অথবা খোদা না করুক অন্য ক্ষমতার জোরে যাঁরা জিতে আসবেন, তাঁরা আইন করবেন, পুলিশ-প্রশাসন চালাবেন। তাঁরা সংসদে-সরকারে বসে ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব পাবেন। নিজেদের না, গণমানুষের ভবিষ্যৎ। এমন ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ সৎপথে আয়-রোজগার করতে পারবে। দিনের শেষে নিশ্চিন্তে নিরাপদে প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারবে, গুম হবে না। হারিয়ে যাবে না।
ভ-য়ে আরও আছে ভূত। ভূত বলতে অতীত। ভূতের চেয়ে ভবিষ্যৎ একটুখানি অন্তত ভালো হবে, আজ অন্তত সেই আশা করার সুযোগটুকু থাকবে তো?
কুর্রাতুল–আইন–তাহ্মিনা: সাংবাদিক