বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর শীলপাড়ায় একটি বাড়িতে আগুন দিয়ে একই পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে মেরেছিল দুর্বৃত্তরা। সেটা ২০০৩ সালে। এর মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতার নানা পালাবদল ঘটেছে। বিএনপির পর এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার, তারও পর আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ১০ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কোনো বিচার হয়নি এখনো। মামলার পেছনে ছুটতে ছুটতে পরিবারটির একমাত্র প্রাণে বেঁচে যাওয়া সদস্য বিমল শীলের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ১৫টি বছর। সেদিনের ৩৫ বছর বয়সী তাগড়া জোয়ানটি এখন প্রৌঢ়ত্বের দুয়ারে। পোড়াবাড়ির ভিটায় নতুন করে বাড়ি তোলা হয়নি। শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে দুর্বহ শোক ও বেদনার সাক্ষী হয়ে।
দেশে এখন নির্বাচনের তোড়জোড় আর প্রচারণা চলছে। কিন্তু সেই উৎসবে শামিল হওয়ার মতো মনের জোর কোথায় বিমল শীল বা শীলপাড়ার মানুষের? ১৯ ডিসেম্বর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় গিয়ে নির্বাচন নিয়ে তাঁদের ভাবনা জানতে চাইলে পাওয়া গেল শুধুই বিষণ্ন নীরবতা। মুখ খুলতে রাজি নন কেউই। বাবুল শীল (৪৩) বা শচীন্দ্রলাল শীল (৭০) যেন ভোট নিয়ে কথা বলে নতুন করে বিপদে জড়াতে চান না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় যে পাবে, তা বলা বাহুল্য।
নির্বাচনী আমেজ অবশ্য পাওয়া গেল বৈলছড়ির দিকে গিয়ে। বৈলছড়ি বাজারে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে চতুর্মুখী। এ এলাকার বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের মুস্তাফিজুর রহমান ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারও নৌকা প্রতীক পেয়েছেন তিনি। বিএনপির প্রার্থী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন তিনবার। কিন্তু এবার তাঁকে ছাড় দেয়নি জামায়াত। জামায়াতের এখানে শক্ত ভিত্তি আছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তিনজনই জামায়াতের। চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম পদত্যাগ করে তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী (আপেল) হিসেবে শক্তি পরীক্ষায় নেমেছেন। একই ভাবে মহাজোটের সমঝোতাও কার্যকর হয়নি এখানে। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন এ এলাকার সাবেক সাংসদ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হোমিও চিকিৎসক (৬৫) কথা বললেন রীতিমতো নির্বাচন বিশেষজ্ঞের মতো। তাঁর মতে, বাঁশখালী উপজেলা ঐতিহ্যগতভাবেই আওয়ামী লীগবিরোধী এলাকা। ১৯৭০-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে যে গুটিকয়েক আসনে আওয়ামী লীগ হেরেছিল, তার মধ্যে বাঁশখালী একটি। ২০১৪-এর একতরফা নির্বাচনের আগে মাত্র একবার জিতেছিল আওয়ামী লীগ। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পরে জাতীয় পার্টির দুঃসময়ে এই দলের প্রার্থী মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে মাত্র ৪৭৮ ভোটে হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সুলতান আহমদ চৌধুরী।
তাহলে এবার কী হবে?—এ প্রশ্নের উত্তরে এই ‘নির্বাচন বিশেষজ্ঞ’ বললেন, এবারের হিসাবটা জটিল। বিএনপি-জামায়াত ভোট ভাগাভাগি হবে, আবার লাঙ্গল-নৌকারও ভোট ভাগাভাগি হবে। এর মধ্যে কার কপাল খোলে, সেটাই দেখার বিষয়।
এত হিসাব–নিকাশ করে কথা বলতে রাজি নন বৈলছড়ি বাজারের লুঙ্গি-গামছার দোকানদার নুরুল আলম। তিনি বললেন, ‘লাঙ্গল পাস করবে, ফাইট হবে আপেলের সঙ্গে।’ লাঙ্গল জিতবে—এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে বাজারের আরেক দোকানি আবদুল হাফেজ (৬৫) বললেন, ‘ফাইট হবে নৌকার সঙ্গে। আপেল মার্কার জহিরুল ইসলাম সাড়ে চার বছর উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন, কিন্তু এলাকার কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি।’ সবজিবিক্রেতা ওয়াইজুন্নবী (৫০), বা অটোরিকশাচালক মো. রফিকও (২৯) লাঙ্গল জিতবে বলে মত দিলেন। তবে কানে কানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলে গেলেন, এটা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ির পাশের এলাকা বলে তাঁরা সবাই লাঙ্গলের সমর্থক।
তাঁদের কথার সত্যতা যাচাই করতে উপজেলা সদরের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে নৌকার প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমানের একদল তরুণ সমর্থককে দেখা গেল বিভিন্ন যানবাহনে তাঁদের প্রার্থীর সমর্থনে স্টিকার লাগাচ্ছেন। তাঁরা সমস্বরে জানালেন, নৌকা জিতবে। কার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, লাঙ্গলের সঙ্গে।
চৌমুহনী বাজারে বিয়ের সাজসরঞ্জাম ভাড়া দেওয়া হয়, এমন একটি দোকানে বসে ছিলেন তরুণ হুমায়ুন কবির (২৪)। তাঁর মতে, ধানের শীষ জিতবে। আপেল অথবা লাঙ্গলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। একই এলাকার পোশাকসামগ্রী দোকানের মালিক সুমন কান্তি দে (৪৫) বললেন, লড়াই হবে নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে। পাশের লেপ-তোশকের দোকানের স্বত্বাধিকারী মাহমুদুল হকও (৩২) বললেন একই কথা, নৌকা ও লাঙ্গল।
চেচুরিয়া বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে জানতে চেয়েছিলাম, নির্বাচনের পরিবেশ কেমন? দোকানি সুবল দে (৪৮) জানালেন, এখনো সবকিছু ভালোই চলছে। এখানে চা খেতে এসেছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তাঁরাও বললেন, কোথাও গোলযোগের খবর পাননি। কিন্তু নুরুন্নবী (২৮) নামের এক তরুণ বললেন, গণ্ডামারায় মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর নির্বাচনী সমাবেশে যাওয়ার পথে তাঁর সমর্থকেরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাধার মুখে পড়েছেন।
ব্যাপারটাকে তেমন গুরুতর কিছু মনে হয়নি তখন। কারণ, ছোটখাটো হাতাহাতিকেও বড় করে দেখাতে চান অনেকেই। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে বাঁশখালী ছেড়ে কিছু দূর আসার পর শুনতে পেলাম সরল বাজারে গণসংযোগ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী জাফরুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করেছেন, মুখোশধারী ৩০-৪০ জন সন্ত্রাসী অতর্কিতে হামলা চালায় তাঁর ওপর। বন্দুকের বাঁট ও লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাঁকে। তাঁর কর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। এর মাত্র এক দিন পরেই চাম্বলবাজারে মাহমুদুল ইসলামের সমাবেশে হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আহত জাতীয় পার্টির ১৫ কর্মীকে রাতে ভর্তি করা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মাহমুদুল ইসলাম এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। এ ব্যাপারে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।
চতুর্মুখী লড়াইয়ের একটা জমজমাট নির্বাচনী মাঠ দেখে এসেছি বাঁশখালীতে। কিন্তু ‘ফাউল’ খেলে এই পরিবেশটা নষ্ট করলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে নির্বাচন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে প্রশাসন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]