'নির্বাচন তো হয়েই গেছে....'

অগ্নিসংযোগের পর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়ায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস
অগ্নিসংযোগের পর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়ায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস

গতকাল সকাল ৯টায় ঢাকাগামী বাসে উঠতেই দেখি আমার আসনের এক সারি পেছনের আসন থেকে কালো জ্যাকেট পরা এক ভদ্রলোক মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। ওপাশে কে ছিলেন জানি না। তবে তিনি বারবারই বলছিলেন, পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে আটক কর্মীদের ছাড়িয়ে দিতে পারি, তারা যদি আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিল করে, প্রচার চালায়।

 তাঁর কথায় কৌতূহল হলো। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি যাঁদের কথা বলেছেন, পুলিশ কেন তাঁদের ধরেছিল?

ভদ্রলোক বললেন, তাঁরা বিএনপি করেন। তঁারা যাতে নির্বাচনী প্রচারে নামতে না পারেন, সে জন্য  কাউকে মামলা দিয়ে, কাউকে মামলা ছাড়াই থানায় ধরে নিয়ে গেছে। এরপর টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। আমরা বলেছি, ছাড়ানোর জন্য যত টাকা লাগে দেব কিন্তু মুচলেকা দিতে পারব না যে তাঁরা আওয়ামী লীগের মিছিলে যাবেন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেল, কয়েক মাস আগে তিনিও একটি নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। নভেম্বরে জামিনে ছাড়া পেলেও মামলা আছে। টাঙ্গাইল সদরে তাঁর বাড়ি। টাঙ্গাইল-৫  নির্বাচনী আসনে তাঁরা ধানের শীষের প্রার্থী মাহমুদ হাসানের পক্ষে কাজ করছেন।

তাঁকে জিজ্ঞেস করি, বিএনপির কোন পদে আছেন? তিনি স্পষ্ট কিছু না বলে জানালেন, ‘দল যখন করি তখন কোনো না–কোনো কমিটিতে তো আছি।’ নাম জানতে চাইলে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন, ডাকনাম হাবিব। এই  ভদ্রলোক ব্যবসা করেন এবং স্বীকার করলেন, নির্বাচনের কারণে তিনি হয়রানির শিকার হলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অর্থাৎ সরকার ব্যবসাবান্ধব; নির্বাচনবান্ধব নয়।

শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগার মিলনায়তনে আলাপ হচ্ছিল স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক-লেখকের সঙ্গে। কবি মাহমুদ কামাল এই গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা বলে তাঁকে ঘিরেই এখানে সান্ধ্য আড্ডা জমে ওঠে। আলোচনায় অনিবার্যভাবে জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গও এল। তাঁদের বক্তব্যে মনে হলো নির্বাচনে কী হবে, সেটি তো সবার জানা। এ জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অতীতে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—এ রকম একজন বললেন, ‘সামরিক শাসক এরশাদ ও জিয়াউর রহমানের আমলেও নির্বাচন করেছি। কিন্তু এ রকম নির্বাচন কখনো দেখিনি। অন্য সময়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করা হলেও নির্বাচনের সময় ছেড়ে দেওয়া হয়। জিয়া ও এরশাদের সময় নির্বাচনে যেতে বিরোধী দলের পূর্বশর্তই ছিল আটক নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দিতে হবে। অনেকে মুক্তি পেয়েছেন, আবার অনেকে পাননি। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে ধরপাকড়ের ঘটনা কখনো ঘটেনি।’

টাঙ্গাইলের সাংবাদিক বন্ধুরা গত বুধবার প্রথম আলোয় ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে যে প্রধান খবর ছাপা হলো, তার প্রশংসা করে বললেন, আপনারা সাহস করে সত্য বলেছেন। তবে এই গায়েবি মামলা তো শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই ঘটছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে অসংখ্য নাশকতার মামলা হয়েছে। একজন ঠাট্টা করে বললেন, পুলিশের এই মামলার ধরন দেখে ছোটবেলায় পড়া টোনাটুনির গল্পের কথাই মনে পড়ে। কোথাও কিছু না ঘটলেও পুলিশ বলছে নাশকতা হচ্ছে। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি নাশকতা হবে, তখন মানুষ বিশ্বাস করবে না।

 তাঁরাও স্বীকার করলেন, টাঙ্গাইল সদর আসনে মোটামুটি নির্বাচনী উত্তাপ থাকলেও বাইরে সবকিছু একতরফা চলছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বাইরে কোনো দলের প্রার্থীর প্রচার নেই বললেই চলে। দুপুরে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোশাররফকে কোনো অঘটনের কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর গাড়িবহরে হামলার পর এখানে কোনো হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা নেই। কিন্তু রাতেই খবর পেলাম কালিহাতীর রতনগঞ্জে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপির ১০-১২ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই দিন দেলদুয়ারেও আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী ক্যাম্প পোড়ার খবর পাওয়া গেল। রাত তিনটায় কে বা কারা আগুন দিয়েছে। আশপাশের লোকজন দেখে পুলিশকে খবর দিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। যেখানে বিএনপির কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অফিসে আগুন দেবে—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। তা–ও রাত তিনটায়। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী এবং আওয়ামী লীগের আহসানুল ইসলাম টিটি। স্থানীয় সাংবাদিকদের শঙ্কা, নির্বাচনের আগে এ রকম নির্বাচনী অফিস পোড়ানোর ঘটনা আরও ঘটবে, যাতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের নামে মামলা দিতে সুবিধা হয়। 

শুক্রবার টাঙ্গাইল থেকে কালিহাতী যেতে নৌকার বেশ কিছু নির্বাচনী ক্যাম্প দেখলেও ধানের শীষের কোনো ক্যাম্প চোখে পড়েনি। বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেও চান না গ্রেপ্তার–হয়রানির ভয়ে। আগের দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের দুই সাংবাদিক বন্ধু তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তাঁরা টিভির বিরাট লটবহর নিয়ে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের আটটি আসনের নির্বাচন প্রচারকাজ দেখতে। জিজ্ঞাসা করলাম, নির্বাচন কেমন দেখলেন? ‘নির্বাচন তো হয়েই গেছে।’

নির্বাচন হয়ে গেছে মানে? জবাবে একজন বললেন, কোথাও ধানের শীষের প্রচার দেখিনি। সবখানে নৌকার প্রচার। মিছিল, পোস্টার। প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্যও বিএনপির লোকজন পাওয়া যায় না। ভয়ে কেউ কথা বলেন না।

বাসে থাকতেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার ঘাটাইল থেকে টেলিফোন করলেন। তিনি একসময় ঢাকায় বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। এখন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ঘাটাইলের খবর কী। তিনি বললেন, এখানে নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী দুজনই প্রচার চালাচ্ছেন। তবে ধানের শীষের প্রার্থী লুৎফর রহমান আজাদ কিছুটা অসুস্থ বলে তাঁর প্রচার কম।

এই আসনের সাংসদ আমানুর রহমান খান মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় এবং কারাগারে থাকায় আওয়ামী লীগ তাঁর বাবা আতাউর রহমান খানকে প্রার্থী করেছে। এ নিয়ে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের মধ্যে চাপা ক্ষোভও আছে। মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাহার আহমেদ বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ‘খুনের আসামির বাবাকে মনোনয়ন দেওয়ায় আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব বলেছেন, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তিনিও তো অপরাধ করেননি। খুনের বিচার হবে। আমরা মেনে নিয়েছি।’ কিন্তু খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ও সাংসদ আমানুর রহমান খানের (রানা) ভাই সহিদুর রহমান খান (মুক্তি) কীভাবে নির্বাচনী প্রচার চালান? এ আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।  কেননা, নাশকতার মামলা নিয়েই পুলিশ ব্যস্ত। টাঙ্গাইলের সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে আরও জানা গেল, নির্বাচন সামনে রেখে সাংসদ আমানুরের অনুসারীরা এখন ঘাটাইলে ঘাঁটি গেড়েছে। সে ক্ষেত্রে সেখানে বিএনপির নেতা–কর্মীরা কতটা প্রচার করতে পারছেন, সে বিষয়ে সংশয় আছে।

অনেক দিন ধরেই টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগে তিনটি ধারা চলে আসছিল। একটি ধারা হলো সিদ্দিকী পরিবার, যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকী। পরে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ করলে লতিফ সিদ্দিকী এই ধারার নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ২০১৪ সালে তিনিও দলীয় পদ ও মন্ত্রিত্ব হারালে আওয়ামী লীগ সিদ্দিকী পরিবারমুক্ত হয়। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকে খুশি হলেও খান পরিবারের দাপটে চিন্তিত। তাঁরা মনে করেন, খান ও সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাব থেকে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগকে বের করে আনতে না পারলে দলের বদনাম ঘুচবে না। টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগে দুই পরিবারের বাইরে যে ধারাটি আছে, তারা দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে আগ্রহী।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com