‘দাদখানি চাল, মসুরের ডাল, চিনি-পাতা দই, দুটা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম ভরা কৈ’ আওড়াতে আওড়াতে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘কাজের ছেলে’ কবিতায় খোকাবাবু যাচ্ছিলেন বাজারে। বাবুর মনে ভয়, ‘ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয় ছিঁড়ে দেবে চুল!’ আগামী ভোটযুদ্ধের আগে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ: আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা ভোটদাতাদের সামনে পাখি পড়ার মতো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ফর্দ আউড়ে চলেছেন। নির্বাচনে হেরে মায়ের হাতে অপদস্থ হওয়ার ভয় তাঁদেরও আছে বৈকি।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বাংলাদেশে মূলত দুটি দল—আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধী। অন্তর্লীন স্তরে পরিস্থিতি জটিলতর। দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া বহু বিচিত্র ঘটনার ঘনঘটার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানত সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের ভোটাররা কমপক্ষে তিনটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে আছেন। প্রথম খণ্ডটি বাঙালি সংস্কৃতি এবং ধর্ম উভয়ই যথাসম্ভব বজায় রাখার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় খণ্ডটি ধর্মকে বেশি গুরুত্ব দিতে ইচ্ছুক এবং বাঙালি সংস্কৃতি যথাসম্ভব বাদ দিতে চায়। তৃতীয় খণ্ডটি সাধারণত রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মেলাতে চায় না।
ভূপৃষ্ঠের টেকটোনিক প্লেটগুলোর মতো বাংলাদেশের এই তিনটি জনখণ্ড পরস্পরকে কমবেশি ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে এবং সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এই তিন জনখণ্ডের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উপরিউক্ত প্রতিটি জনখণ্ডের একাধিক উপখণ্ড রয়েছে এবং এই তিন জনখণ্ডের সদস্যদের মধ্যে দল বা পক্ষ বদলের ঘটনাও বিরল নয়। সত্তরের দশকে তৃতীয় খণ্ডের দুটি প্রধান উপখণ্ড ছিল, যার একটি ছিল মস্কোপন্থী, অন্যটি পিকিংপন্থী। মস্কো যেহেতু ১৯৭১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে ছিল, সেহেতু মস্কোপন্থী উপখণ্ডটি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। পিকিংপন্থী উপখণ্ডের একটি অংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল বটে, কিন্তু অন্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধকে (চীনের তৎকালীন বিদেশনীতি অনুসরণ করে) ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বিবেচনা করে নির্লিপ্ত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের রাজাকার-আলবদর বাহিনী এই নির্লিপ্ত বুদ্ধিজীবীদেরও রেয়াত করেনি, এঁদের মধ্যে অনেককেই তারা হত্যা করেছিল ১৪ ডিসেম্বর বা তার আগে। প্রথম খণ্ডের একটি উপখণ্ড স্বাধীনতার পরপরই জাসদ গঠন করে মূল দলের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রধানতম মাইলফলক। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে উপরিউক্ত তিন খণ্ডের দৃষ্টিভঙ্গি তিন ধরনের। প্রথম খণ্ড ভাবে, যেহেতু বাংলাদেশ তারাই স্বাধীন করেছে, সেহেতু বাংলাদেশ তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি। মুক্তিযুদ্ধে অন্যরা সঙ্গে ছিল, তবে কেউ সঙ্গে না থাকলেও স্বাধীনতা আটকাত না। দ্বিতীয় খণ্ড তো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতাই করেছিল এবং এখনো তারা বাংলাদেশকে ‘বাংলাস্থান’ বানাতে তৎপর। তৃতীয় খণ্ডের কোনো কোনো নেতা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ তাঁরাই স্বাধীন করবেন। কিন্তু বহু বিচিত্র কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের হাতে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর তৃতীয় খণ্ডের কেউ কেউ প্রথম খণ্ডকে প্রস্তাব দিয়েছিল সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে কিন্তু প্রথম খণ্ড এই প্রস্তাব মোটেই আমলে নেয়নি। বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে এমনিতেই জনগণ প্রথম খণ্ডকেই ভোট দিত, তবু কমবেশি কারচুপি করে প্রথম খণ্ড নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিল। তাতেও অবশ্য সন্তুষ্ট হয়নি তারা, প্রায় দুই দশকের জন্য ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে একদলীয় শাসন চালু করেছিল তারা। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেনাশাসন যুগের সূচনা হয়। এই যুগের প্রথম পর্বে (১৯৭৫-১৯৮১) মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় খণ্ডের কট্টরতম অংশটি, অর্থাৎ রাজাকার-আলবদরদের পুনর্বাসিত করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে (১৯৮২-১৯৯০) এরশাদীয় স্বৈরাচার যুগে এবং দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক যুগের প্রথম পর্বে (১৯৯১-১৯৯৬) দ্বিতীয় খণ্ডের সার্বিক অবস্থা প্রথম খণ্ডের তুলনায় ভালো ছিল। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক যুগের দ্বিতীয় পর্বে (১৯৯৬-২০০১) প্রথম খণ্ড ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় খণ্ডের কট্টরতম উপখণ্ডটির সমর্থনের প্রয়োজন হয়েছিল এবং তৃতীয় পর্বে (২০০১-২০০৬) এই উপখণ্ডের নেতারা মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। অবশেষে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থার দায় কাঁধে নিয়ে দ্বিতীয় খণ্ড ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছিল।
প্রায় দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক শাসনের প্রথম খণ্ড পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দুই পর্বে (২০০৯-২০১৮) দেশ শাসন করে। দ্বিতীয় খণ্ডের অভিযোগ: ১. দ্বিতীয় পর্বকে (২০১৪-২০১৮) ‘গণতান্ত্রিক’ বলা যায় না, কারণ এই পর্বে প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্বাচন হয়নি এবং সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, ২. উন্নয়নের আড়ালে প্রচুর দুর্নীতি ও পুকুরচুরি হয়েছে এবং ৩. বিরোধী দল গুম, খুন, ক্রসফায়ার, কারারুদ্ধ হওয়াসহ চরম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে।
অল্প কয়েক দিন পরেই প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। ভোটযুদ্ধে আবার মুখোমুখি হয়েছে মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। প্রথম খণ্ড দাবি করছে যে তাদের সময়ে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। তারা বলছে, ‘আমরা নির্বাচিত না হলে উন্নয়নের মুক্তধারা থেমে যাবে এবং দেশ ভূতের মতো পেছন দিকে হেঁটে পাকিস্তানের মতো একটি অকার্যকর দেশে পরিণত হবে।’ দ্বিতীয় খণ্ড ভারতবিরোধী ছিল, কিন্তু এবারের নির্বাচনে ভারতের বিরুদ্ধে এখনো টুঁ শব্দটি করেনি। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয়, উভয় খণ্ডই যে ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, তাতে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। তবু কোন খণ্ড অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্নীতি করেছে—এই প্রশ্ন তুলে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের সমর্থকেরা ব্যাপক তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন।
মনে করা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের ভোটদাতার সংখ্যা মোটামুটি স্থির এবং খোকাবাবুরা অর্থাৎ নবীন ভোটাররাই নির্ধারণ করবেন, কোন জনখণ্ডটি ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবে। সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রাপ্ত মোট ভোটের সংখ্যার ভিত্তিতে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না। তা ছাড়া, বাজারে যাওয়ার পথে ঘোষদের ননির ঘুড়ি ওড়ানো, ভোলা-ভুতু-হাবার খেলা দেখতে দেখতে সব ভুলে গিয়ে খোকাবাবু ভুল করে আওড়াতে থাকেন: ‘দাদখানি বেল, মসুরের তেল, সরিষার কৈ, চিনি-পাতা চাল, দুটি পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।’ এর মানে হচ্ছে, আকাশে কার কোন ঘুড়িটা কখন উড়বে, অথবা ভোলা-ভুতু-হাবারা কে কোথায় কেমন খেলবে ইত্যাদি অনেকগুলো নিয়ামকের ওপর নির্ভর করবে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন-মহাসংগ্রামে বাংলাদেশের কোন জনখণ্ডটির সদস্যরা শেষ হাসিটা হাসবে।
শিশির ভট্টাচার্য্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক