একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে আশান্বিত হতে পারছি না। নির্বাচনের তিনটি ধাপ। প্রাক্–নির্বাচনী পর্ব, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকাল ও নির্বাচন এবং নির্বাচন–পরবর্তী পর্ব। আমরা এখন আছি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকালে। দলগুলো ঠিকমতো প্রার্থী মনোনয়ন করতে পারছে কি না, প্রার্থীরা প্রচার–প্রচারণায় সমান সুযোগ পাচ্ছেন কি না ইত্যাদি এ সময়ে প্রধান বিবেচ্য। সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, সে পরিবেশটি নেই। ঢাকায় সাদা চোখেই দেখতে পাচ্ছি, সব প্রার্থী প্রচারের সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। আমার এলাকায় শুধু সরকারদলীয় প্রার্থীর পোস্টার। বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী পোস্টার চোখে পড়েনি। সমান প্রচারের সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধা আসছে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের বাধার অভিযোগ আসছে। এবারের মতো প্রার্থীদের ওপর এত হামলা আগে কখনো হয়নি। সারা দেশে বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকদের আটক ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
প্রার্থীদের ওপর এসব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার প্রভাব নির্বাচনে পড়তে শুরু করেছে। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ, এমনটি চলতে থাকলে চূড়ান্ত ক্ষতির শিকার হবেন ভোটাররা। তাঁরা ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। ভোট দিতে যাওয়ার ব্যাপারেও তাঁরা সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। নির্বাচন কমিশনার এবং একজন নির্বাচন গবেষক হিসেবে বলতে পারি, চলমান অবস্থা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বহু মানুষ—বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ ও নারী ভোটাররা—ভোট দিতে যাবেন কি না, তা নিয়ে ভাববেন। এ সংশয় সংক্রামক ব্যাধির মতো। একবার ছড়ালে তা বাড়তে থাকে।
আর এসব কারণে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে সংশয় বাড়ছে। তাদের কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা আছে, তা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে যে বিতর্ক হলো, সেটা এড়ানো উচিত ছিল। এসব বাদ-প্রতিবাদের কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা কমে আসে। সবার মত এক হবে না। কিন্তু মতপার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরি।
নির্বাচনের আর অল্প কিছুদিন বাকি। নির্বাচন কমিশন এখনো চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো—পুলিশ, বিজিবি, আনসারদের দিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। ২৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী নামবে। নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে তারাও সহযোগিতা করতে পারে। তবে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে পুলিশকেই। তাদের আচরণের মধ্য দিয়েই নির্বাচন কমিশনের সফলতা প্রমাণিত হবে। ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বদলিও করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের আছে। সে ক্ষমতা তাদের ব্যবহার করতে দেখিনি।
নির্বাচনকালে সাংবাদিকতা নিয়েও কিছু কথা আছে। এমন একটি আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে যে নির্বাচনকালে তথ্যপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। সাংবাদিকদের ছবি তোলা বা মুঠোফোন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হতে পারে। টেলিভিশনগুলোকে যদি সরাসরি সম্প্রচার করতে দেওয়া না হয়, তাহলে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। গণমাধ্যমের ওপর এ রকম প্রতিবন্ধকতা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। নির্বাচন কমিশনের চোখ ও কান হচ্ছে গণমাধ্যম। এই ডিজিটাল যুগে নির্বাচন কমিশনকে আরও অগ্রসর ও যত্নবান হতে হবে। নির্বাচনকালে সংবাদকর্মীদের জন্য একটা নীতিমালা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদেরও সতর্ক ভূমিকার দরকার আছে। কোনো ভোটকেন্দ্রে তাঁরাও যেন অযাচিত ঘটনা না ঘটান।
*লেখক: সাবেক নির্বাচন কমিশনার
* লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব