হিরো আলমের 'হাইকোর্ট' বনাম ইসি
বোঝেন অবস্থা! প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে তুচ্ছ করে কথা বলেন! সেই নাগরিক আবার নির্বাচনে দাঁড়ানো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়। সেও বলে যে “নির্বাচন কমিশনকে আমরা হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়ছি।” বোঝেন অবস্থা!’ সাবালক ব্যক্তিকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা সাধারণ ভদ্রতা। কিন্তু হিরো আলমের সঙ্গে সেটুকু করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না ইসি সচিব!
‘সে’ সর্বনামটি তুমি-তুই পর্যায়ের। ধরে নিলাম ইসি সচিব বাংলা ভালো জানেন না। কিন্তু ‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়!’ বলে রাগ ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ তো ভালো ভাবেই করলেন। পরিষ্কার জমিদারি মানসিকতা তাঁর ভাষার পরতে পরতে। একজন সরকারি কর্মকর্তা এভাবে কথা বলতে পারেন? প্রকাশ্যে? একজন হবু জনপ্রতিনিধিকে উদ্দেশ করে? এভাবে কথা বলত ইংরেজ শাসকেরা, পাকিস্তানি দখলদারেরা। এভাবে কথা বলতেন সাবেক জমিদারেরা। এখনো বলেন কোনো কোনো মাফিয়া নেতা। কিন্তু একজন সচিবের মুখে তো এই ভাষা শোভা পেতে পারে না। এই কথাটায় সচিব সাহেবের মনের এক্স-রেটা পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। তিনি লজ্জা না পান, এমন ‘জমিদার’ সাহেব নিয়ে আমরা লজ্জিত।
হিরো আলম কে বা কী, তাঁর সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান দেখার দরকার নেই। নির্বাচন কমিশনের বাতিল করা প্রার্থিতা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি ফিরে পেয়েছেন, এতে কারোরই গোসসা করার কিছু নেই। কিন্তু তাতেই আক্রোশ জাগল ইসি সচিবের মনে।
প্রথমে বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা আলম সাহেবের প্রার্থিতা বাতিল করেন। তারপর তিনি আপিল করেন ইসি বরাবর। ইসিও পত্রপাঠ তাঁকে ফিরিয়ে দিলে তিনি আদালতের শরণ নেন। উচ্চ আদালত ইসির সিদ্ধান্ত বাতিল করায় ইসি সচিবের হয়তো আঁতে লেগেছে। কিন্তু উচ্চ আদালত যে একটি ন্যায্য সিদ্ধান্ত দিয়ে একজন প্রার্থীকে বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, ইসির ভুল শুধরে দিয়েছেন, তাতে করে ইসি নিজেই একটি সম্ভাব্য অবিচারের দায় থেকে রেহাই পেয়েছে; সেটা ইসি সচিব তা বুঝলেন না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব, চাকরি ও পদের শপথ ভেঙে ‘রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী’ হয়েই হিরো আলমের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছিল, যেভাবে বাতিল হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের আরও অনেকের প্রার্থিতা? এখন উচ্চ আদালত হিরো আলমের বেলায় ইসির ভুল সংশোধন করায় ইসি সচিবের মুখে এহেন ভাষা? তাই ঝি-কে (হিরো আলম) মেরে বউয়ের (উচ্চ আদালত) ওপর রাগ ঝাড়া?
মনে আছে কোনো কোনো সাংবাদিকও টিভির পর্দায় হিরো আলমকে অশৈল ভাষা ও ভঙ্গিতে জেরা করেছেন। জাতের বড়াইয়ের মতো শিক্ষা, রূপ, ক্ষমতার বড়াইও একটা সাংস্কৃতিক ব্যাধি। হিরো আলম উঠে আসা মানুষ। যাঁরা আরও তলায় আছেন, যাঁদের বড়াই করার মতো কিছু নেই, তাঁদের তাহলে কী চোখে দেখা হয়?
নিম্নবর্গের লোক হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানো তাঁর জন্য সহজ হয়নি। তিনি প্রথমে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপত্র কিনলেন। কিন্তু সেই দল তাঁকে মনোনয়ন দিল না। তারপর তিনি ‘স্বতন্ত্র’ হলেন। তারপর জেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করলেন। তিনি গেলেন ইসির কাছে। ইসি বাতিল করলে গেলেন আদালতের দুয়ারে। এই সংগ্রাম ও আত্মবিশ্বাস কি তুচ্ছ করার জিনিস? হিরো আলম কেন, কোনো মানুষকেই রাষ্ট্রীয় পদে থেকে এভাবে তুচ্ছ করা যায় না, তুই-তুমি করা যায় না। মানুষকে সম্মান দিতে না পারা মানে নিজেকেই অসম্মানিত করা। ইসি সচিব যা করলেন, তাতে হিরো আলম আরও হিরোই হবেন, কিন্তু ইসি সচিবের সম্মান ও তাঁর ওপর অর্পিত আস্থায় আরও চিড় ধরল। আশা করি তিনি দুঃখ প্রকাশ করে নিজের ও নাগরিকদের সম্মান রক্ষা করবেন।
হিরো আলম নিজে কিছু হোন না-হোন, তিনি আমাদের ‘এলিট’ ও ক্ষমতাবানদের ভালোই পরীক্ষায় ফেলেছেন। সব ব্যক্তি সমান এবং মর্যাদাবান, সভ্যতার এই পরীক্ষায় একের পর এক অনেকেই হিরো আলমের কাছে ফেল করছেন। এক হিরো আলমেই এত গা-জ্বালা, নিচু তলা থেকে হাজারো হিরো আলম উঠে এলে ‘নব্য জমিদারেরা’ কী করবেন?
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]