একাত্তর সালজুড়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক, হিন্দুধর্মাবলম্বী এবং বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের হদিস পেলে নিধন করা ছিল তাদের মিশন। ফলে তাঁদের জন্য দেশান্তরি হওয়া নয়তো আত্মগোপন করা ছাড়া পথ ছিল না। অনেকে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন, অনেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। শরণার্থীদের জীবন কেটেছে চরম কষ্ট ও অবমাননার মধ্যে। আর দেশের ভেতরে সক্রিয় যোদ্ধা ও পলাতক শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর দল চরম ঝুঁকি ও প্রতিমুহূর্তে ধরা পড়া, আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।
পাকিস্তানি, অর্থাৎ অবাঙালি হানাদারদের ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হতো যদি তাদের দেশীয় দোসর জুটে না যেত। রাজাকার, আলবদর আর শান্তি কমিটির সদস্যরা তো ছড়িয়ে ছিল সারা দেশেই। ফলে পুরো নয় মাস তাঁদের কেটেছে চরম আতঙ্কে। অথচ মানুষকে তার জৈবিক অস্তিত্বটুকু রক্ষা করতে হলেও কোনো গোপন আস্তানায় একেবারে নিষ্ক্রিয় কাটানো সম্ভব নয়। সারাটা সময় দেশের এখানে-ওখানে এই তিন ধরনের মানুষ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের আমরা বুদ্ধিজীবী পরিচয়েই চিহ্নিত করেছি।
আসল কথাটা হলো পাকিস্তানি শাসকদের দল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিজাতীয় ধারণা হিসেবে ঘৃণা করেছে। তাদের বিচারে এটি ছিল ভারতীয় এবং হিন্দু চেতনা, তাই ঘৃণ্য এবং পরিত্যাজ্য। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা কিনা মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং এর নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতীয় নেতা বলে মান্য করেছিলেন, তাঁরা উপলব্ধি করলেন যে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে হাজার বছরে গড়ে ওঠা যৌথ সাধনার সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা যায় না। ভাষা, সাহিত্য, সংগীত ও অন্যান্য কলা এবং কৃতীকে ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজন ও তা প্রত্যাখ্যানের কোনো যুক্তিযুক্ত পথ নেই। কারণ, তাতে একটি ভাষিক জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
এক অর্থে বাংলাদেশের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলন থেকেই। আর সে হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের জয়যাত্রার সূচনা করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরাই। পাকিস্তানের আক্রমণের লক্ষ্য যে তাঁরা হবেন, তা তো জানাই ছিল। এখনো আমরা সম্পূর্ণ জানি না কত বুদ্ধিজীবী দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, পাকিস্তানের পরাজয় যখন আসন্ন, তখন তারা আলবদর বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। যুদ্ধের সূচনায় বেছে বেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছিল। আর শেষ পর্যায়েও হত্যাযজ্ঞের শিকার বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই। তবে ডাক্তার, সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীসহ এ সংখ্যা বিপুল। হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানো সম্ভব না হলেও তার চেতনার বিকাশ যেন রুদ্ধ করা যায়।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের গতিপথ বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিরুদ্ধ শক্তি বা বিভ্রান্ত শক্তিকে মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করতে হয়েছে, এমনকি সাময়িক কালের জন্য গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব দিলেন দেশকে চেতনার দিক থেকে পাকিস্তানের কাছাকাছি ফিরিয়ে আনার কাজে। সেই কাজে তিনি বহুলাংশে সফল হয়েছিলেন। সেই যে ফিরতিযাত্রার সূচনা হলো তা সম্পূর্ণ থামানো যায়নি। এর পেছনে অবশ্য দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা প্রভাবও কাজ করেছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় বুদ্ধিজীবী নিধনের ফলে এই রাষ্ট্রীয় পশ্চাৎপদ রাজনীতি প্রতিরোধের শক্তি তো খর্ব হয়েছিলই।
আজকে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এ দেশ প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা যেমন স্মরণ করব, তেমনি ভাবতে হবে কেন গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অবস্থান থেকে গণচেতনা এতটা পিছিয়ে পড়ল। অনেক উন্নয়নের মধ্যেও গণতন্ত্রের পথ সুগম হয়নি। শিক্ষার এত বিস্তার সত্ত্বেও যুক্তি-মননচর্চায় দুর্বলতা কেবলই বাড়ছে, মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে, ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি আরও দীর্ঘায়িত ও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়ছে এবং নানা ক্ষেত্রে তার প্রকাশ প্রকটতর হচ্ছে। এখন তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্ববর্তী দুই দশকে বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকেরা যে চেতনার ধারা তৈরি করেছিলেন, যে ধারায় এগিয়ে চলার পথ রচনা করেছিলেন রাজনীতিবিদেরা, আজ কি আমরা তারই ধারাবাহিকতায় পথ চলছি?
এটা সত্য যে এঁদের এবং অগণিত দেশপ্রেমিক মানুষের প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়েই তো স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। তাঁদের প্রতি জাতির একটিই অঙ্গীকার থাকতে পারে—তা হলো সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম করা। আত্মবিসর্জন দেওয়া শহীদ এবং সেদিনের সব সংগ্রামী মানুষের নেতা হিসেবে প্রতীকী অর্থে অবশ্য বলা যায় যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কথা। সে স্বপ্ন কি বাস্তবায়িত হচ্ছে? আমরা কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ও তাঁদের স্মরণ করার অধিকার অর্জন করেছি?
তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য–সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তারই শীর্ষ প্রকাশ আমাদের জাতীয়তাবাদ। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় ইংরেজি ভাষা শেখার ওপর নিশ্চয় গুরুত্ব বাড়বে, কিন্তু তা অবশ্যই মাতৃভাষার বিনিময়ে নয়। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হবে, বাংলা ভাষাচর্চার অবস্থা আজ শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর ভাষাচর্চায় দুর্বলতা জাতির সংস্কৃতি ও কলাচর্চার ধারাকেও ব্যাহত করছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো মানুষের দেশপ্রেম বাস্তবের দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, তা থেকে যাচ্ছে ফাঁপা এবং ঠুনকো। এমন মানুষের কাছ থেকে দেশের আইন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আশা করা যায় না। বাস্তবে তা পাওয়াও যাচ্ছে না। হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সমঝোতা করেই অর্থনীতিকে চলতে হবে; কিন্তু তা একশ্রেণির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া, দেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি হওয়া এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া বা রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের বৃত্তে আবদ্ধ মানুষের কবজায় চলে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সাংঘর্ষিক।
উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছেও জার্মান, ফরাসি, ইংরেজরা ভাষা-সংস্কৃতিসহ জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য হারায়নি। চীন, জাপান বা কোরিয়ার দিকে তাকালেও তা–ই দেখব। জাতিসত্তা যদি ব্যক্তিসত্তার মর্মে প্রাণশক্তির জোগান না দেয়, তাহলে সে মানুষ এবং তাদের সৃষ্ট জাতি আপন ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য ও কৃতী ধরে রাখতে পারে না। বিদ্যুৎ, সড়ক, নদীমাতৃক দেশে সেতু নির্মাণ উন্নয়নের মৌলিক ক্ষেত্র ও কৃষিতে উৎপাদনের পরিমাণও গুরুত্বপূর্ণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য পরিষেবার অগ্রগতিও আমাদের এগিয়ে চলারই প্রমাণ। কিন্তু যে কারণে বুদ্ধিজীবীরা ভাষার প্রশ্নে আপসহীন লড়াই চালিয়েছিলেন তার মোদ্দা কথাটা ছিল বাঙালির আত্মবিকাশ। গত ৬০ বছরে আমাদের এ বিশ্বে চেতনা ও প্রযুক্তিতে যে বিপুল সংযোজন-পরিবর্তন ঘটেছে তার ফলে গ্রহণ-বর্জনের গুরুত্ব বেড়েছে, ক্ষুদ্র আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে, ধর্মের প্রায়োগিক ক্ষেত্র ও ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের সঙ্গেও নবতর চেতনার বোঝাপড়ার প্রয়োজন রয়েছে এবং হয়তো সব মিলে ষাটের দশকের জাতিসত্তার রূপকল্পটি নবায়নের প্রশ্ন বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। সব মেনেই দুটি কথা মানতে হবে—প্রথমত, এই নবায়নের কাজটিও বুদ্ধিজীবীদেরই করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে সব নবায়ন-পুনর্নির্মাণ সত্ত্বেও জাতিসত্তারও একটি ধ্রুব-চেতনা রয়েছে, যা অবিনশ্বর না হলেও দীর্ঘজীবী। তাই ইউরোপে দেখি নতুন বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি আবার জাতিসত্তার ক্ষুদ্রতর বিন্যাস ও প্রকাশও ঘটছে—সেটি যেমন জার্মান-ফরাসিতে দেখি, তেমনি দেখতে পাই চেক-স্লোভাক স্বাতন্ত্র্যে, বসনিয়া-মেসিডোনিয়ার স্বাধীনতায়, কুর্দি বা চেচেনদের মুক্তির লড়াইয়ে।
স্বাধীনতা এক মহান গন্তব্য, কিন্তু জাতির অভিযাত্রার সমাপ্তি নয়, এতে নবায়ন-পুনর্নির্মাণের সুযোগ ও দায় এসে পড়ে বটে; কিন্তু এ তো ইতিহাসেরই যাত্রাপথ—এর ভবিষ্যৎ আছে বলেই ইতিহাসের সম্পদ-সঞ্চয়ের গুরুত্বও বেড়ে যায়। সে কথা আমরা যেন ভুলতে বসেছি। তাতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ যেন অলীক হয়ে উঠছে।
আবুল মোমেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক