খেলা বেশ জমে উঠেছে। যাঁরা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন এখন আর ব্যক্তিগতভাবে কোনো খেলায় অংশ নেওয়া যায় না। যেতে হয় ক্লাবের মাধ্যমে। পাড়া-মহল্লার শখের খেলাধুলার ব্যাপার অবশ্য আলাদা। রাজনীতির মাঠে ‘স্বতন্ত্র’দের জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা অংশ নিলে ব্যালট পেপার নাকি খুব লম্বা হয়ে যায়। তা ছাড়া, প্রতিযোগী বেশি হলে তাঁদের মার্কা খুঁজে পেতে বিড়ম্বনা হয়। এখন জাতীয় সংসদ, এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও হয় ক্লাবভিত্তিক। রাজনৈতিক দলগুলোই হলো ক্লাব।
কোনো লিগ বা টুর্নামেন্ট হলে তার আগে খেলোয়াড়দের দলবদলের একটা সুযোগ থাকে। খেলোয়াড়েরা পুরোনো দলে থেকে যাওয়া বা অন্য দলে যাওয়ার সময় দুটো বিষয় বিবেচনা করেন—কোথায় গেলে জয়ের সম্ভাবনা বেশি এবং টাকা কোথায় বেশি পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলোয়াড় কেনাবেচায় ক্লাবগুলোর একটা ভূমিকা থাকে। চুক্তি ভেঙে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দলবদল করলে বড় রকমের অর্থদণ্ড দিতে হয়। যে ক্লাব পছন্দের খেলোয়াড়কে ভাগিয়ে আনবে বা কিনে নেবে, ওই খেলোয়াড় আগে যে ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন, তাদেরও দিতে-থুতে হয়। পশ্চিমের দেশগুলোতে এ এক বিশাল বাণিজ্য, ইন্ডাস্ট্রি। তার হাওয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। আমরা ক্রমাগত পেশাদার হয়ে উঠছি।
এ দেশের মানুষ বেশির ভাগই মুখ্যু-সুখ্যু। চাষবাস করে খায়, অন্যের জমিতে মজুর খাটে, অফিস-আদালতে ফাইলের পাহাড়ের নিচে মুখ ঢেকে জীবন কাটায়। খায়দায়, বংশ বৃদ্ধি করে। রাজনীতি তাদের কাছে অন্য রকম মাজেজা নিয়ে আসে। একসময় মনে হতো—ওহো, দেখো দেখো, রাজনীতির জন্য লোকটা সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে কতই না কষ্ট করছে। বিয়েথা পর্যন্ত করেনি। মরে গেলে কবরে বাতি জ্বালানোরও কেউ নেই।
কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ নিয়ে একটি গবেষণার কাজ করতে গিয়ে পুরোনো লোকদের সঙ্গে কথাবার্তার প্রয়োজন হলো। যোগাযোগ হলো আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রী জাহানারা খানের সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স ৮৩ বছর। কিন্তু স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর।
আওয়ামী লীগের প্রথম অফিস ছিল ইয়ার মোহাম্মদ খানের ঢাকার কারকুনবাড়ি লেনের বাসায়। তিনি যত দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন, এ দলটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ইত্তেফাক পত্রিকার মালিক ছিলেন তিনি। মানিক মিয়াকে ডেকে এনে সম্পাদকের চাকরি দিয়েছিলেন। পরে পত্রিকার মালিকানার হাতবদল হয়। তো তাঁর স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ইয়ার মোহাম্মদ খানের অনেকগুলো বাড়ি আর জমি ছিল ঢাকায়। তিনি বাড়ি বেচে রাজনীতি করেছেন। এখন তো লোকে রাজনীতি বেচে বাড়ির মালিক হয়।
কথাটি আমার মনে ধরল। ৪০-৫০ বছর আগেও যাঁরা মফস্বল শহর বা গ্রাম থেকে খালি পায়ে বা রাবারের চপ্পল পরে এক প্রস্থ কাপড় সম্বল করে ঢাকায় এসেছিলেন, ঢাকার পার্টি অফিসগুলোর খিড়কি-দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতেন, ভেতরে ঢোকার সাহস পেতেন না, তাঁদের অনেকের হাতেই এখন আলাদিনের চেরাগ। ২০০৭ সালে এ দেশের রাজনীতিতে একটি সুনামি বয়ে গিয়েছিল। তখন অনেকেই দামি দামি গাড়ি পথেঘাটে ফেলে দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। কারও কারও ঠাঁই হয়েছিল নাজিমুদ্দিন রোডের দালানটিতে। তখন আমি জানতে পারলাম, ‘পোরশে’ নামে একটি গাড়ি আছে। পত্রিকায় লেখালেখি হলো কার কার আছে পোরশে কিংবা বিএমডব্লিউ, দাম কত এবং কত সিসি। দুই দশক আগেও তাঁরা অনেকেই ছেঁড়া চটি পায়ে দিয়ে ঢাকায় হাঁটাহাঁটি করতেন। রাজনীতি তাঁদের অনেককেই খাদের কিনারা থেকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেছে।
রাজনীতির এই যে জাদু, এর জিয়নকাঠিটি হাতে পেতে উদ্গ্রীব অনেকেই। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পাশে বড় দালানটির ভেতরে ঢোকার জন্য কত চেষ্টা, কত আয়োজন! এবার তো আট হাজারের বেশি লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন একটি টিকিটের জন্য। শিকে ছিঁড়েছে ভাগ্যবান কয়েক শ লোকের কপালে। আগামী কয়েক সপ্তাহ তাঁরা এই টিকিট দেখিয়ে দেশ চষে বেড়াবেন এবং দেশকে দুধ ও মধুর সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার, সবই দেবেন।
বোকা লোকেরা এখনো মনে করেন, রাজনীতির মাঠে আদর্শবাদের হাওয়া এখনো ‘মৃদুমন্দ বয়’। তো সেই আদর্শবাদের নমুনা এখন প্রকট। এখন তো লড়াইটা হচ্ছে প্রধানত দুই ক্লাবের মধ্যে। একটির লোগো হলো ‘উন্নয়ন’, অন্যটির ‘সুশাসন’। উন্নয়নের ব্যাপারটি আগেই বলেছি। ওই দালানে ঢুকতে পারলে তাঁরা যে পায়ের ওপর পা রেখে কয়েক পুরুষ পরমানন্দে খেতে-পরতে পারবেন, তাতে সন্দেহ নেই। নমুনা জরিপ করলেই এটা প্রমাণ করা যাবে। তাঁরা ‘কেয়া থা আওর কেয়া হুয়া’! এই পরিবর্তনটিকেই আমরা বলি ‘উন্নয়ন’।
সুশাসন জিনিসটি হাত দিয়ে ধরা যায় না, চেখেও বোঝা যায় না। এটা প্রতিনিয়ত ঠাহর পাওয়া যায়। তো যাঁরা সুশাসনের কথা বলছেন, তাঁরা অনেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ওই দালানে ছিলেন। তখন তাঁরা কী বলেছেন, কী করেছেন, তার রেকর্ড রয়ে গেছে গণমাধ্যমে, নানান দলিলে।
এ মুহূর্তে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যেতে ইচ্ছা করে ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবরে। সেদিন বিকেলে ১৪-দলীয় জোটের প্রধান শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে
রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে দেখা করে ১১টি বিষয়ে ২০ দফা দাবিনামা দিয়েছিলেন। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন; প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের অপসারণ, ‘দলীয়’ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে তাঁদের নিয়োগ আদেশ স্থগিত করা, সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা, অ্যাটর্নি জেনারেলকে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে আলোচনার ভিত্তিতে নতুন একজনকে দায়িত্ব দেওয়া; পুলিশ বাহিনীতে স্পর্শকাতর সব পদে পরিবর্তন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও ও সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সব সংবাদ ও প্রচারমাধ্যমে ১৪-দলীয় জোট, এলডিপি ও আওয়ামী লীগকে যথাযথ অধিকার দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দান, গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি রেডিও-টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ এবং মালিকদের অর্থের অনুসন্ধান, ৪ অক্টোবরের পর দেশব্যাপী যত ধরপাকড় ও মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি, ১ জানুয়ারি থেকে উন্নয়ন বিষয়ে যত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যথা প্রকল্প অনুমোদন, থোক বরাদ্দ, প্রকল্প চুক্তি এবং এ-সম্পর্কিত অর্থ অবমুক্তি—সব অকার্যকর ও স্থগিত করা ইত্যাদি (সূত্র: ইত্তেফাক, ৩১ অক্টোবর ২০০৬)।
একই দিন ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনের সড়কে আয়োজিত চারদলীয় জোটের এক সমাবেশে জোটনেত্রী খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা অনেক মার খেয়েছে, অনেক রক্ত দিয়েছে। আর ধৈর্য ধরবে না, মার খাবে না। পাল্টা জবাব দেবে। এখন আমাদের এগিয়ে যাবার পালা। তারা বাংলাদেশে খায়দায় আর সহযোগিতা করে অন্য দেশকে। এরা জাতীয় বেইমান। এরা দেশের অনেক ক্ষতি করেছে। ওরা লাশের রাজনীতি করে আবার নিজ মুখে বলে একটার বদলে দশটা লাশ চাই। জনগণ আর তাদের ঠাঁই দিবে না (সূত্র: ওই)।
১২ বছর পর দৃশ্যপট প্রায় একই রকম আছে। কিন্তু ক্লাবগুলোর কথাবার্তায় অদলবদল হয়েছে। এর কথা ও বলছে, ওর কথা এ বলছে।
মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]