কৃষকেরাই পথ দেখাচ্ছেন ভারতকে
‘আজাদি হয়নি আজও তোর/ নব-বন্ধন শৃঙ্খল ডোর/ দুঃখ রাত্রি হয়নি ভোর/ আগে কদম কদম চল জোর।’ হবিগঞ্জের সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই আহ্বান অনেক পুরোনো। এরপর বহু বছর কেটেছে। সময় বদলেছে, কিন্তু কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতার জীবন বদলায়নি। এখনো খরা-বন্যায় ফসলহানি হলে কৃষককে দাঁড়াতে এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে দাঁড়িয়ে শুধু মৃত্যুকেই দেখা যায় স্পষ্টভাবে। অন্নের জোগানদাতা এই মেহনতি মানুষেরাও যেন এই অবস্থাকেই একমাত্র ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাদের কানে যেন কোনো হেমাঙ্গ বিশ্বাস ঠিক পৌঁছায় না। দুঃখ রাত্রি ভোর না হলেও তারা জোর কদমে এগিয়ে যায় না। কিন্তু পরিচিত এই দৃশ্যই যেন হঠাৎ বদলে দিল দিল্লির পথে নেমে আসা লাল পতাকার স্রোত। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সেই আহ্বানে হঠাৎ করেই ‘দরিয়ার ডাকে দিল সাড়া মহাভারতের জনতা’।
এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দিল্লির রাজপথে, আইনসভা অভিমুখে কৃষকদের মিছিল এক দারুণ দৃশ্যের অবতারণা করেছে, যা বলছে মানুষ বেঁচে আছে, মানুষ উত্তর চায়, সর্বংসহা অন্নদাতারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পীড়নের অবসান চায়। ‘কৌন বানায়া হিন্দুস্তান? ভারতকে মজদুর কিষান’—এই স্লোগানে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার মুখরিত দিল্লির রাজপথ বলছে, আজকের ভারতের প্রকৃত নির্মাতাদের ভুলে গেলে চলবে না। এই স্লোগান বলছে, শিল্পোন্নত, বাণিজ্য, জিডিপির হিসাব এবং এ–সম্পর্কিত নানা আখ্যানের নিচে কৃষকদের অবদানকে চাপা দেওয়া যাবে না।
কৃষকদের ভারতের সংসদ ঘেরাও অভিযানে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার থেকে হাজার হাজার কৃষক সমবেত হন রাজধানী দিল্লিতে। দেশের সব প্রান্ত থেকে আসা কৃষকেরা রাজধানীর চার প্রান্ত থেকে মিছিল করে সমবেত হন রামলীলা ময়দানে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যেই দিল্লির রামলীলা ময়দানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। শুক্রবার সকালেই তাঁরা রওনা দেন আইনসভার দিকে। ‘কিষান মুক্তি মোর্চা’ নামে কৃষকদের এই সমাবেশ ভারতের রাজধানীকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সমবেতদের অধিকাংশের হাতে লাল পতাকা। কারও কারও হাতে ছিল সেই কৃষকের ছবি, যিনি অভাবের তাড়নায় ঋণের চাপে পিষ্ট হয়ে এক সময় বেছে নিয়েছেন ‘আত্মহত্যা’ নামের সর্বশেষ ‘মুক্তির পথ’। কারও হাতে রয়েছে আত্মহত্যা করা কৃষকদের স্মরণে আনা মাথার খুলি। সে অর্থে দিল্লিতে সমবেত হয়েছিলেন ভারতের জীবিত-মৃত সব কৃষক। তাঁরা সোচ্চারে বলছেন, ‘অযোধ্যা নাহি, কর্জি মাফ চাহিয়ে’ (অযোধ্যা নয়, ঋণ মওকুফ চাই)। সুস্পষ্ট কথা। কোনো ভণিতা নেই। ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের রামরাজত্বের স্বপ্নের সরাসরি প্রত্যাখ্যান।
আইনসভা ঘেরাও করে লাখো কৃষকের এই সমাবেশ বর্তমান বিজেপি সরকারের প্রতি হতাশার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ। ট্রেনে-বাসে চড়ে, পায় হেঁটে ২৪টি রাজ্য থেকে আসা এই কৃষকেরা ফসলের ন্যায্যমূল্য চাইতে এসেছেন, এসেছেন ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার যৌক্তিক দাবি নিয়ে। সর্বভারতীয় কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ব্যানারে দুই শতাধিক কৃষক সংগঠনের অংশগ্রহণে এই সমাবেশ থেকে দাবি উঠেছে ভূমি সংস্কার, ঋণ মওকুফ ও দুর্যোগের কারণে ফসলহানি হলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার। তাঁরা দাবি তুলেছেন, কৃষি ও কৃষকদের সংকট নিরসনে সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের।
দিল্লিতে সর্বশেষ এ ধরনের কৃষকসমাবেশ হয়েছিল গত ২ অক্টোবর। অবশ্য সে সময় কৃষকদের দিল্লিতে প্রবেশের মুখেই বাধা দেয় প্রশাসন। দাবি নিয়ে আসা কৃষকদের পথ রুখতে চিরাচরিত পন্থায় শক্তি প্রয়োগ করে প্রশাসন। পুলিশের সঙ্গে হওয়া সেই সংঘর্ষে আহত হন বহু কৃষক। কিন্তু এবার দৃশ্যপট ভিন্ন। এবার আর দিল্লি প্রবেশে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি তাঁদের। যদিও নিয়ম মেনেই ব্যারিকেড রয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার পুলিশ। কিন্তু এখনো তারা মারমুখী নয়।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে লাখো এই কৃষকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী, কবি, শিল্পী, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষেরা। তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সমর্থন জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। দেশজুড়ে বাম ধারার বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত সর্বভারতীয় কৃষকসভা রয়েছে এই আয়োজনের মূলে, যা প্রথমবারের মতো কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টিসহ (এনসিপি) ভারতীয় সংসদে বিরোধী পক্ষে থাকা ২১টি রাজনৈতিক দলকে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। এই ঘটনা ঘটছে মহারাষ্ট্রে, মুম্বাই অভিমুখে হাজারো কৃষকের মিছিল ও বিক্ষোভের মাত্র এক সপ্তাহ ব্যবধানে। বারবার ফিরে আসা এই কৃষকদের ঢেউ ভারতের রাজনীতির অভিমুখ বদলে দেওয়ার চিহ্নবাহী।
সমাবেশে সিপিআই (এম) নেতা ও কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেন, দেশজুড়ে কৃষকেরা বিক্ষোভে ফুঁসছেন। তাঁদের এই ক্ষোভকে ভাষা দিতেই এই অভিযান। সমাবেশ থেকে স্বামীনাথন কমিশনের করা সুপারিশ বাস্তবায়নের জোর দাবি উঠেছে। দল-মতনির্বিশেষে এই দাবি উত্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, এম এস স্বামীনাথনকে প্রধান করে গঠিত ন্যাশনাল কমিশন ফর ফারমার্স ২০০৪ সালে তার প্রতিবেদন পেশ করে। ওই প্রতিবেদনে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল। কিন্তু কমিশনের সেই প্রতিবেদনে করা সুপারিশগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অথচ বিশ্বশক্তির কাতারে নিজের অন্তর্ভুক্তি দাবি করা ভারত প্রতিবছর দেখছে কৃষকদের আত্মহত্যা। এই সুপারিশগুলোই বাস্তবায়নের জোর দাবি উঠেছে এবারের সমাবেশ থেকে। এ বছরই ভারত তার কৃষকদের এমন বেশ কয়েকটি জমায়েত প্রত্যক্ষ করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বিজেপি সরকার চালু করে একটি বিমা প্রকল্প। ‘বিমা যোজনা’ নামের এই প্রকল্পও কৃষকদের নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভাষায় কৃষকদের দুঃখ লাঘবের বদলে এই বিমা উল্টো পকেটপূর্তি করেছে বিমা কোম্পানিগুলোর। তিনি একে ‘লুট যোজনা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কৃষকসমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে সিপিআই (এম)–এর প্রধান সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘বিজেপি সরকার তাদের ব্যর্থতা থেকে কৃষকসহ সারা দেশের মানুষের নজর অন্যদিকে ফেরাতে বিভাজনের রাজনীতি করছে। এই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের কৃষকদের নিয়ে কথা বলা উচিত।’
সমাবেশে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের দিনেশ ত্রিবেদীও। তিনি কৃষকদের এই সমাবেশকে যথার্থভাবেই ভারতের ‘সংসদ’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি কৃষকদের এই সংসদে প্রস্তাব পাসের কথা বলেন, যা শুধু সমর্থনের এখতিয়ার রয়েছে ‘তথাকথিত সংসদের’। আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল সমাবেশ থেকে সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, কৃষিঋণ মওকুফ, ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং কৃষকদের ফসল কেনার কেউ না থাকলে তা সরকার কিনে নিতে হবে। সমাবেশে যোগ দেওয়া প্রত্যেক নেতা স্বামীনাথান কমিশনের প্রতিবেদনে করা প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা বলেছেন।
এনসিপি–প্রধান ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ার আইনসভায় উত্থাপিত সিপিআই (এম) সাংসদ কে কে রাগেশ ও মহারাষ্ট্রের কৃষকনেতা ও সাংসদ রাজু শেট্টির আনা কৃষকদের ঋণমুক্তি ও ফসলের লাভজনক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তার দাবিতে আনা দুটি বিল পাসের দাবি জানান। তিনি বলেন, এই আইনের প্রতি সংসদের ২১টি বিরোধী দলের সমর্থন রয়েছে।
সমাবেশ থেকে কৃষকেরা বলেছেন, তাঁরা কোনো কৃপা চান না, শুধু ন্যায্যতা চান। এই দাবির স্বপক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘দেশের মাত্র ১৫ জন ধনকুবেরের সাড়ে তিন লাখ কোটি রুপির ঋণ যখন (নরেন্দ্র) মোদি মওকুফ করতে পারেন, তখন কেন তিনি কৃষকদের জন্য তা করতে পারবেন না। তারা কোনো উপহার চাইতে আসেনি।’
দিল্লিতে কৃষকদের এই সমাবেশ অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই সমাবেশ ভারতের বর্তমান দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতিতে ততোধিক বিভক্ত বিরোধী দলগুলোকে অন্তত এক মঞ্চে এনে দাঁড় করাতে পেরেছে। দিল্লিতে জমায়েত হতে থাকা কৃষকেরা এক কথায় তুলে ধরেছেন সমগ্র ভারতকে। সারা রাত প্রচণ্ড ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করে তাঁরা রামলীলা ময়দানে যেভাবে সমাবেশের জন্য অপেক্ষা করেছেন, তা ভারতের সাধারণ মানুষের লড়াইটাকেই তুলে ধরে। এই কৃষক দলে ছিলেন তামিলনাড়ু থেকে আসা কৃষকেরাও, যাঁদের সঙ্গে ছিল আত্মহত্যা করা আট কৃষকের মাথার খুলি। মৃত সেই সঙ্গীর হাড় নিয়ে এই কৃষকেরা যেন প্রবৃদ্ধির গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভারতের কঙ্কালটিই দেখিয়ে দিলেন। এই কঙ্কাল শুধু ভারতের সংকটকেই তুলে ধরছে না, রাজনৈতিক অভিমুখেরও একটি ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ফজলুল কবির: সহসম্পাদক, প্রথম আলো