দূরদেশে যাব না, একেবারে ঘরের পাশে ভারতের কথা দিয়ে শুরু করি। ত্রিপুরা ভারতের একটি ছোট্ট, গরিব ও পশ্চাৎপদ রাজ্য। বাংলাদেশের আখাউড়া সীমান্ত পার হলেই ত্রিপুরার রাজধানী ছোট্ট শহর আগরতলা। ২০১৬ সালে প্রথম আগরতলা দর্শনে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। কী সুন্দর সুনসান শহর। কোথাও কোনো বিলবোর্ড, প্যানাসাইন কিংবা পোস্টার, ফেস্টুন নেই। রাস্তায় পড়ে নেই কাগজের একটি টুকরোও। নেই কোনো রাজনৈতিক দলের মহিমা ঘোষণার এতটুকু চেষ্টা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই এসব বালাইমুক্ত। এমনকি দেয়ালে নেই পেনসিলের সামান্য দাগও। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। ত্রিপুরায় তখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায়।
২০১০ সালের নভেম্বরে যাই ভারতের কেরালা রাজ্যের বিখ্যাত কোচি (আগের নাম কোচিন) শহরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে। আমরা কোচি পৌঁছার মাত্র এক সপ্তাহ আগে সেখানে পৌর নির্বাচন হয়ে গেছে। কিন্তু শহরে কোথাও তার চিহ্নমাত্র বোঝার উপায় নেই। কেরালার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের শহর এত সুন্দর, পরিপাটি রেখেছ কী করে? তোমাদের রাজনীতির প্রচারণা কোথায়? একজন হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওসব তো তোমাদের বাঙালি কালচার, কলকাতায় দেখো রাজনীতির ওরকম উৎকট প্রকাশ।’ যদিও আমি বাংলাদেশের, তবু একজন বাঙালি হিসেবে লজ্জা পেয়েছিলাম। বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস পালা করে কেরালা শাসন করে।
প্রায় একই অভিজ্ঞতা দিল্লির নির্বাচনেও। সেখানে অবশ্য নির্দিষ্ট স্থানে একই মাপের, একই ধরনের ছোট বোর্ডে প্রার্থী বা দলের কিছু প্রচারণা চোখে পড়েছিল। তাতে বিজেপি ও প্রতিপক্ষ আম আদমি পার্টির মধ্যে বিভেদ করতে পারিনি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরালায় বামফ্রন্ট দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু কেরালা বা ত্রিপুরা যা পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গ তা পারল না কেন? পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট টানা ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। বামফ্রন্টের পর তৃণমূলের শাসন চলছে প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু কালচার তেমন বদলায়নি। তৃণমূল, বিজেপির বিলবোর্ডে সারা পশ্চিমবঙ্গ সয়লাব।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় উৎসব রাজনীতির ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনে প্রকাশ পায়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও পাল্লা দিয়ে বিলবোর্ড বসায়। নাগরিক সুবিধা-অসুবিধার ধার ধারে না। রাজধানী তো পোস্টার, বিলবোর্ড, প্যানাবোর্ড, ফেস্টুনে সয়লাব থাকে সারা বছর। দুর্গম চর বা গ্রামেও এই কুৎসিত রুচির মহড়া চলছে। নেতা-নেত্রীর প্রশস্তি, আত্মপ্রচার, অন্যের চরিত্রহনন—কী থাকে না সেখানে? ঈদ, পূজায়, নববর্ষে দেশবাসীর প্রতি শুভেচ্ছা–বৃষ্টি সবই চলে এই তরিকায়।
আত্মপ্রচারের ঠেলায় বিশ্বের ৬ নম্বর প্রতিবেশ ঝুঁকির দেশ বাংলাদেশ কী ধরনের অপচয়, অপব্যয় ও পরিবেশ–সংকট সৃষ্টি করছে? সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কথা কে না জানে। উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপন্নতা একসূত্রে গাঁথা। তাই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব যতটা সম্ভব কম রেখে উন্নয়ন করার চেষ্টা। এখানে পরিবেশ বিপন্নকারী মাত্র দুটো উপসর্গ নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। মানবসভ্যতার অন্যতম প্রধান উপকরণ কাগজ। এই কাগজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল গাছ। কাগজ উৎপাদন ও গাছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই পরিবেশবাদীরা কাগজের ব্যবহার যথাসম্ভব কম রাখতে দীর্ঘকাল যাবৎ আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতি খণ্ড কাগজের সঙ্গে যুক্ত গাছের জীবন। আর কে না জানে, গাছ হলো অক্সিজেন কারখানা। তাই যত বেশি কাগজের ব্যবহার, তত বেশি গাছের বলি। অথচ আমরা অনর্থক প্রচারণায় কাগজের পোস্টার ছেপে সারা দেশের দেয়ালে, দড়িতে সেঁটে দিচ্ছি, যার ৯৫ শতাংশই কোনো সুফল বয়ে আনে না। স্রেফ অপচয় ছাড়া এ ধরনের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন কোনোই আবেদন সৃষ্টি করে না। বরং নাগরিকের অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে। অথচ আমরা নাকি এগুলো বানাই, লাগাই জনগণের মন জয় করতে, নেতা-নেত্রীদের নজর কাড়তে।
হালে বিলবোর্ড–প্যানাবোর্ড যেখানে–সেখানে। প্যানাসাইন কাগজের চেয়েও মারাত্মক। কাগজ তবু সহজে নষ্ট হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে; কিন্তু এই প্যানাসাইন সহজে নষ্ট হয় না, কারণ তা বায়ো-ডিসপোজিবল নয়। ব্যবহার শেষে ফেলে দিলে কিংবা ধ্বংস করতে পুড়িয়ে ফেললে পরিবেশের আরও বেশি সর্বনাশ ঘটায়। মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষিত করে। ক্যানসারসহ নানা রোগের বিস্তারের উৎসে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ সবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, মধ্যম আয়ের দেশ হতে আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। অপব্যয়ীকে শয়তানের ভাই বলা হয়। যেসব জাতি উন্নতি করেছে, তাদের উন্নয়নের প্রধান সূত্র ছিল সঞ্চয়, অর্থাৎ যথাসম্ভব ব্যয়সাশ্রয়। আমরা এখনো পুঁজি সঞ্চয়ের আদি পর্ব অতিক্রম করতে পারিনি। কতটুকু উন্নতির স্বপ্ন দেখতে পারি? সে উন্নয়ন কি আদৌ টেকসই হবে? আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বসতি, খাবার কোনোটিই এমনকি এশীয় মানও স্পর্শ করেনি। শিক্ষা খাতে আমাদের সরকারি বরাদ্দ আফ্রিকার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো থেকেও কম। আর গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যাপক অব্যবস্থাপনা। খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে বটে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় এখনো কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো শহরে, গ্রামে, চরাঞ্চলে অত্যন্ত নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। এত সব সমস্যার মধ্যে আমরা কি প্রচারের মিথ্যা ছলনা থেকে আত্মমুক্তির সন্ধান করতে পারি না?
পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। প্রতিবছর এ খাতে কত হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়, অর্থনীতিবিদেরা তা গবেষণা করে দেখতে পারেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রচারণার উপকরণ সরিয়ে নেওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে, অধিকাংশ উপকরণ সরানো হয়েছে, তবে এখন অনেক জায়গায় কিছু নির্বাচনী প্রচার উপকরণ দেখা যাচ্ছে। সব দ্রুত সরিয়ে ফেলা হোক। সুন্দর পরিবেশ বজায় থাক। অপচয় বন্ধ হোক। কেন এই সংস্কৃতি আমরা সারা বছর জারি রাখতে পারব না? ত্রিপুরা পারলে, কেরালা পারলে আমরা বীর বাঙালি তা পারব না কেন? তাহলে দেশ বাঁচবে, অর্থ বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে। বাঁচবে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীও।
আমিরুল আলম খান যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan7 @gmail. com