জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি ৪০ দিনের কম সময়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি, তা সহজেই দৃশ্যমান। ক্ষমতাসীন জোটের পুরোনো ও নতুন শরিকেরা যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে, তার বিপরীতে বিরোধীরা ততটাই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিরোধীদের দমনে সরকারের যে ভূমিকা ছিল, এখন তা আরও কঠোর রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। নির্বাচন কমিশন যদিও সেসব বিষয়ে একধরনের নীরবতা পালনকেই যথাযথ বলে বিবেচনা করছে। কমিশনের ভূমিকায় মনে হচ্ছে, তারা যেনতেন প্রকারে নির্বাচন করতেই আগ্রহী। মুখে যা-ই বলুক না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন যে আগ্রহী, তাদের আচরণে সেটা মনে হচ্ছে না। বিরোধী দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রস্তুতি বা আগ্রহ তাদের আদৌ ছিল কি না, তাদের আচরণে এমন প্রশ্নও ওঠে।
কয়েক মাস আগেও দেশের রাজনীতির যে পরিস্থিতি ছিল, এখন যে তার বদল ঘটেছে এবং ক্ষমতাসীনদের একটি শক্তিশালী নির্বাচনী প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে, তা বোঝার জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার শরিকেরা এই কিছুদিন আগেও যে মনোভাব দেখিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছিল যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে চাপের মধ্যে রেখেই তারা নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পারবে। অনেকের ধারণা ছিল, উত্থাপিত দাবিদাওয়া মেনে না নেওয়ার কারণে বিএনপির সামনে নির্বাচন বর্জনের বিকল্প থাকবে না অথবা ‘অংশগ্রহণ না বর্জন’—এই প্রশ্নে বিএনপি বিভক্ত হয়ে পড়বে। শুধু তা-ই নয়, অন্য জোট ও দলগুলোও সম্ভবত এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে তৈরি করা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রমাণ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্ভব এই পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা এখন যে তাদের জোটকে সম্প্রসারিত করতে উদ্যোগী হয়েছে, সেটা এ ইঙ্গিত দেয় যে আর যা-ই হোক, প্রতিপক্ষের সংখ্যা ও আকার যেন বড় না হয়, সেটা তাদের বিবেচ্য হয়ে পড়েছে। অন্য জোটগুলোও এখন পর্যন্ত নির্বাচনেরই পথে। ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জনের পথে যাবে না।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে দায়িত্ব বর্তায়, তা পালনের ব্যাপারে কমিশনের উৎসাহ প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, এখন তা আরও বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করছে কি না বা সেটা করতে ইচ্ছুক কি না, সে প্রশ্নও বড় আকার ধারণ করছে।
একদিকে সংসদ সদস্য পদে থেকে নির্বাচনে লড়ার সুযোগ পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরা। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনও সরকারের সাজানো। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার ১২ দিন চলে গেলেও প্রশাসন ও পুলিশে কোনো রদবদল আনার উদ্যোগ নেয়নি।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ মামলার আসামি হয়ে অনেকে কারাগারে, অনেকে ঘরে থাকতে পারছেন না। তফসিল ঘোষণার পরও বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হচ্ছে। ১৮ নভেম্বর বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে ২ হাজার ৪৭টি মামলার তালিকা দিয়েছে। দলটি বলেছে, ৮ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৭৭৩ জন বিএনপির নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার বন্ধে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও তার কোনো ফল হয়নি।
প্রশাসন ও পুলিশের দলীয়করণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যেকোনো সরকারের বেলায় এই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু গত ১০ বছরে এই মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের পর বিভিন্ন ঘটনায় প্রশাসনের, বিশেষ করে পুলিশের আচরণ সরকারি দলের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে। অতীতে নির্বাচনের আগে স্থানীয় প্রশাসনে পরিবর্তন করার উদ্যোগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই গ্রহণ করেছিল। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর এই দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকায় সে দায়িত্ব বর্তেছে কমিশনের ওপর। এ অবস্থায় ৯ নভেম্বর ৬৪টি জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং দুজন ডিভিশনাল কমিশনারকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মনে রাখা দরকার, গত ৩১ জুলাই এবং ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সরকার ৩৬টি জেলায় ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ দিয়েছে; নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগের দিন ৭ নভেম্বর ২৩৫ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টকে পদোন্নতি দিয়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট করা হয়েছে।
নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে যাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের তালিকা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা গোপনে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন। এ নিয়ে খবরের পর ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বা ‘খবরের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে দেওয়া কমিশনের বক্তব্য কেবল দায় এড়ানোর লক্ষণ নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে উঠছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি পুলিশ–প্রশাসনে রদবদল আনার জন্য দুই দফায় কমিশনে দাবি জানিয়েছে। জবাবে কমিশন বলছে, ঢালাওভাবে বদলির প্রস্তাব করলে তা কমিশন গ্রহণ করবে না। কমিশনের এই অবস্থানে এই প্রশ্ন সামনে আসে যে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে কমিশনের সদিচ্ছা আদৌ আছে কি না।
নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এর উদ্দেশ্য হতে পারে, নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্র পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও যাতে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হন এবং বিরোধী পক্ষের কেউ দায়িত্বে আসতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা। আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ভীতসন্ত্রস্ত রাখা।
পুলিশের এই তৎপরতা নিয়ে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন লুকোচুরি করছে। কমিশন দাবি করছে, তারা বিষয়টি জানে না। কিন্তু গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও কমিশনকে পুলিশের এই তৎপরতার বিরুদ্ধে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। কমিশন যদি বলতে চায়, তাদের অজ্ঞাতেই পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যবস্থা নিয়েছে; তাহলে তার অর্থ হচ্ছে তফসিল ঘোষণার পরে প্রশাসনের ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বড় শহরগুলোতে একধরনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন দেখা গেছে। তাই এ প্রশ্নও সামনে আসছে যে একাদশ সংসদ নির্বাচনও কি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো হতে যাচ্ছে?
তফসিল ঘোষণার পর অনেকটা ঘটা করেই দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও সংগ্রহ করে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণ ঘিরে যানজট, দুর্ভোগ ও দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও কমিশন সচিব বলেছিলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে একটি সীমিত এলাকায় জনসমাগম হচ্ছে। তাই এতে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে তাঁদের মনে হচ্ছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণ শেষ হওয়ার পর বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিতরণ ঘিরেও যখন লোকসমাগম শুরু হলো তখন ইসির মনে হলো, আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তারা পুলিশের মহাপরিদর্শককে চিঠিও দেয়। ফলে দেখা গেল, চিঠি দেওয়ার পরদিনই নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ, নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, গ্রেপ্তার।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে দুজন কমিশনারের ভুল স্বীকারকে আমরা ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করব। তবে ঘটনা ঘটার পরে ভুল স্বীকার করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে একই ধরনের আচরণ থেকে তাঁরা নিবৃত্ত থাকবেন বলে আশা করাই স্বাভাবিক। তা হয় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
কমিশনের দায়িত্ব পালনের এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগকেই শক্তিশালী করছে। অবস্থাটি এ রকম যে মনোনয়নপ্রত্যাশী একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলার কারণে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যেতে এ কারণে ভীত যে তাঁকে পথেই গুম করে ফেলা হতে পারে।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে দেশে এবং দেশের বাইরে যেসব সংশয় তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকে অবজ্ঞা করা কমিশনের জন্য বিবেচকের কাজ হবে না। এ কথা মনে করার কারণ নেই যে ভোটাররা এসব লক্ষ করছেন না। এই নির্বাচন অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে অনাকাঙ্ক্ষিত, ব্যাপক এবং সবার জন্যই ক্ষতিকর। কমিশনের সদস্যরা আশা করি তা উপলব্ধি করবেন।
আলী রীয়াজ: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র