ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গাই ভালোবাসি। কচি কলাপাতার মতো সজীব মনটি গড়ে উঠেছে এ দুই শহরকে কেন্দ্র করে। কলকাতা ছেড়েছি বহুদিন। কিন্তু ভুলতে পারিনি। বাল্য, কৈশোরের চেতনা উন্মেষের শহর এ দুটি। বই লিখেছেন অনেকে, আরও লেখা হবে।
জব চার্নককে দেখিনি। দুটি ছোট ছোট গ্রাম। সুতানটি ও গোবিন্দপুর। একদিন আমি আর আমার বন্ধু ঝরনা [ক্লাস ফোর] ট্রামে করে গ্রাম দুটি খুঁজতে বেরোলাম। ট্রামের কন্ডাক্টর বললেন, ‘স্যার, আপনারা কি নতুন এসেছেন?’ বললাম, ‘না, আমরা পার্ক সার্কাসের মডার্ন স্কুলের ছাত্র। আজ গ্রাম দুটি খুঁজতে বেরিয়েছি।’ কন্ডাক্টর ইতিহাসের পণ্ডিত কি না জানি না। বললেন, ‘বাবারা, আসল নামটি ভুলে গেছ। নামটি কলিকাতা। এখন যেখান দিয়ে ট্রাম চলছে তার পুরোটাই ওই তিনটি গ্রামের বুকের ওপর দিয়ে। কলিকাতার উৎস জানো?’ বললাম, ‘না।’ উত্তর হলো: কালীক্ষেত্র। অর্থাৎ যেখানে মা কালী অবস্থান করেন। সংস্কৃতে: কালীক্ষেত্র। আবার কেউ বলেন, এটা এসেছে কালীঘাট থেকে।
দুর্গাপূজা দেখিনি। একদিন ঢুকে পড়ি পূজার মণ্ডপে। হিন্দু মেয়েরা সুন্দর গরদের শাড়ি পরে এসেছেন, কারও মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা। যাঁদের নেই তাঁরা কুমারী। তাঁদের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাই না। দক্ষিণ কলকাতায় ‘দক্ষিণী’তে যাই, ওরা গান শিখতে আসে শুভ গুহঠাকুরতার কাছে। কিশোরীরা গাইছে রবীন্দ্রনাথের গান। আর আমার মন ভরে উঠছে আনন্দে। আমি ও হেনু সম্ভবত প্যান্ট–শার্ট পরে ঢুকেছিলাম। ওখানে ধুতি অথবা শাড়ি ছাড়া প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। কলকাতার দুর্গাপূজার সঙ্গে তুলনা করলাম টাঙ্গাইলের গ্রামের রণদা প্রসাদ সাহার দুর্গাপূজার। অনেক তফাত। রণদা বাবু নিজে আমাদের প্রসাদ খাওয়ালেন, ঘুরিয়ে দেখালেন। আজকের কলকাতায় যে মহাসমারোহ, সেটা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। চারদিকে গান, নাচ, উল্লাস, আরতি, পূজা, সব মিলেমিশে একাকার। মা দুর্গা আসেন শরতের শিউলি ফুল ও কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে, যখন প্রকৃতিতে শারদীয় আহ্বান, তখন। ১০ দিন পর বিসর্জন। সেই মুহূর্তটি উপলব্ধি করার। মা চলে যাচ্ছেন, আবার আসবেন এক বছর পর। এটি আমি বুঝতে পেরেছি।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কাটিয়েছি এক দিন। রবীন্দ্র ভারতী মিউজিয়াম স্থাপন করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। বিল্ডিংটি তখনই ছিল ২১৭ বছরের পুরোনো। রবীন্দ্রনাথের ৪০টি অরিজিনাল পেইন্টিং রাখা আছে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে বসে প্রেমের গানগুলো লিখেছিলেন, সেই জানালার ধারে আমি অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। যাঁরা আমার বইটি পড়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ।
গঙ্গার তীরে বেলুড় মঠে আমার জীবনের একটি চরম উপলব্ধির কথা বলি। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, যাঁর কথা পড়েছি অনেক, তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘তুমি কী করে এলে?’ বললাম, ‘তোমার চরণের কিছু অমৃত আমার জন্য রাখোনি?’ জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা এখানে আসেন বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ মানুষের সান্নিধ্য পেতে। নরেণ ও রামকৃষ্ণ। গঙ্গার শীতল হাওয়া যেন আমি উপলব্ধি করছি এ দুই মহাপুরুষের সান্নিধ্যে। এটি ছিল আমার একটি মনে রাখার মতো দিন।
ঢাকার কথা বললে মনে হবে আমার স্মৃতিবিজড়িত স্কুলের কথা। সেন্ট গ্রেগরি, মুসলিম হাইস্কুল, বাংলাবাজার গার্লস হাইস্কুল, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স কনভেন্ট—এগুলো ছিল আমাদের চারণক্ষেত্র। ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন। এই স্কুলেই পড়তেন অমর্ত্য সেন, আমার থেকে কয়েক বছরের বড়। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, এমনি ঢাকার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। স্কুলের গল্প লিখেছেন শাহরিয়ার কবির। ব্রাদাররা খুব আদর করতেন আমাকে। সারা দিন স্কুলে। বিকেলেও খেলতে স্কুলে।
ঢাকা মানেই পুরান ঢাকা, জৌলুশ এখনো আছে। নতুন ঘোড়ার গাড়ি। আরোহী আটজন। নবাবপুর রোড দাপিয়ে বেড়ায়। ভাড়াও বেশি নয়। পুরান ঢাকা শহর দেখতে হলে ঘোড়ার গাড়ি মন্দ নয়। হোসেনি দালান, নবাববাড়ি ও রূপলাল হাউস। জাহাঙ্গীরনগর ছিল প্রথম নাম। ১৬০৮ সালে এই শহরের প্রতিষ্ঠা। দিনে দিনে বুড়িগঙ্গার তীরে এ শহর এখন মেগাসিটি। কোটি লোকের বাসস্থান। এখানে পুরোনো দিনে মহররমের তাজিয়া ছিল খুবই নামকরা। কয়েক মাইল লম্বা ছিল সেই মিছিল। এখন তা নয়। পৌষসংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ পালিত হচ্ছে বায়ান্ন সাল থেকে। প্রথম সভা আমাদের বাসায় পুরানা পল্টনের হিরামন মঞ্জিলে। কথাটি অনেকেই ভুলে গেছে। এখন বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ কলকাতাকে ছাড়িয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা নতুন বছরে এ দিনে নতুন কাপড় পরে সবাই সবাইকে জানায় ভালোবাসা। সারা দিন গান আর গান। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে এ শহরের পত্তন হলেও ঢাকা নামটি এসেছে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে। যেটি অনেক পুরোনো। অর্থাৎ বল্লাল সেনের সময় দ্বাদশ শতাব্দীতে এর পত্তন। প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয় ১৪৫৪ সালে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এখানকার রাস্তার নামগুলো। রাস্তা খুব বেশি নেই। তাই যানজট। সবই চলছে ধীরগতিতে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে অবাসযোগ্য নগরীর মধ্যে আমাদের ঢাকা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
ঢাকার সম্ভাবনা কী? ছাত্রছাত্রীরা। অনেক নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা খেলাধুলায়ও আগ্রহী। তারা ক্রিকেট থেকে শুরু করে সব খেলাতেই পারদর্শী ও নিজ মেধা প্রদর্শন করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আমেরিকায় গিয়ে দেখি, নতুন অধ্যাপকে ভরে গেছে সব বিশ্ববিদ্যালয়। সবাই আমাদের ছেলেমেয়ে। আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি যে শিক্ষাকে সামনে না আনলে আমরা বড় হতে পারব না। বাংলাদেশ আজ সগৌরবে অগ্রসরমাণ।
একদিন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে হাজির। সেখানে গায়ক পঞ্চানন রায়ের বিয়ে। বরকর্তা আমি, কন্যাকর্তাও আমি। কন্যার হাতটি পঞ্চাননের হাতে দিয়ে আল্লাহকে বললাম, তুমি এই হাত দুটিকে মিলিয়ে দাও। সবাই অবাক। এই ভদ্রলোক তো মুসলমান। এ কী করে বরকর্তা ও কন্যাকর্তা হয়? অন্তর্যামী হাসলেন। বললেন, সবই হয়। ঢাকাই হোক আর কলকাতায় হোক।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী সাহিত্যিক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব