আগামী সরকারের যেসব চ্যালেঞ্জ
ইংরেজি চ্যালেঞ্জ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তবে এর গূঢ়ার্থ বা দ্যোতনা কী, তা কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল পুনর্নির্বাচিত হলে সেটিও হবে নতুন সরকার। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অন্য কোনো দল বা জোট যদি সরকার গঠন করে, সেটি হবে একেবারেই নতুন সরকার। সুষ্ঠু হোক বা অসুষ্ঠু হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই গঠিত হবে, কোনো বিঘ্ন-বিপত্তি না ঘটলে তারা পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রদত্ত ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেই সরকারকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
নির্বাচন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, ভোটাররা যদি সচেতন হন এবং যাঁরা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁরা যদি দক্ষ ও নিরপেক্ষ হন, তাহলে অপেক্ষাকৃত যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীই বিজয়ী হতে পারেন। দলের জন্য কোন নেতা বেশি যোগ্য, তা দলের নীতিনির্ধারকেরা যেমন জানেন, এলাকার জন্য কোন প্রার্থী বেশি গ্রহণযোগ্য, তা এলাকার মানুষেরই ভালো জানার কথা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়ায় আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করেন না। তাঁরা এলাকার ছোটখাটো প্রাপ্তিকেই বড় পাওয়া মনে করেন। একটি কাঁচা রাস্তা পাকা করলেই তাঁরা সন্তুষ্ট। যে সাংসদ তাঁর শ্বশুরবাড়ির বা মামাদের বাড়ির পাশের খালের ওপর একটা সাঁকো বানিয়ে দেন, বা মসজিদ-মাদ্রাসা-বিদ্যালয়ের সংস্কারের জন্য বেশি গম বরাদ্দ করিয়ে দেন, তাঁর প্রশংসায় মানুষ পঞ্চমুখ। আইন প্রণয়নের কাজে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর কতটা, তা নিয়ে ভাবা হয় না।
অতীতে আমাদের নেতারা আন্দোলন–সংগ্রাম করে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ করেছেন, কিন্তু সামন্তবাদী প্রথা আমরা লালন করছি। গণতন্ত্রে সামন্তবাদী প্রথা ঢুকে যাওয়া হলো চিনি ও করলার রস দিয়ে রসগোল্লা বানানো। ওটা কোনো খাদ্যবস্তুর শ্রেণিতে পড়ে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সব নেতাকেই চেনেন। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রত্যেক নেতার যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারণা থাকার কথা। পরবর্তী নির্বাচনে কোন আসনে কাকে মনোনয়ন দেবেন, তা অনেক আগেই ঠিক করা উচিত। তারপরও একাধিক যোগ্য প্রার্থী একই এলাকায় থাকতে পারেন। তখন সমন্বয় করে একজনকে মনোনয়ন দিয়ে অন্যদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়; কেউ যাতে বঞ্চনার শিকার না হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় বা চাকরিতে ইন্টারভিউ হয়। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে রোলকল করে ইন্টারভিউ নেওয়া এক অতিশয় সামন্তবাদী ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এলাকার মানুষের মন জয় করার চেয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের মনোরঞ্জন করাকেই মূল কাজ মনে করেন। যেসব প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন না, এলাকার মানুষের কাছে তাঁরা মুখ দেখাতে পারবেন না।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে দলের সব নেতাই শীর্ষ নেতার সহকর্মী। রাজনৈতিক দল জয়েন্ট স্টক কোম্পানি নয়, শীর্ষ নেতাও কোম্পানির চেয়ারম্যান নন, দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্যরাও কোম্পানির পরিচালক নন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিচের দিকের নেতাদের সম্পর্ক অবাধ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হওয়ার কথা। কেউ যদি কাউকে না–ই চিনলেন, তাহলে কী দল করলেন? চিত্ত যদি ভয়শূন্য না হয় তাহলে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন কীভাবে, স্বাধীন মত প্রকাশ করাই বা কীভাবে সম্ভব। এখন নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে যেমন মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, হয়তো এর পরে অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা মিলিয়ে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। তবে তা যেদিন হবে সেদিন নির্ঘাত প্রশ্নপত্র ফাঁসও হবে।
বিত্তবান বা খ্যাতিমানদের দিয়ে নয়, সুযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই, কিন্তু যেখানে প্রার্থীরই যোগ্যতায় ঘাটতি, সেখানে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনও সুন্দর সংসদ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না। বিনোদনের ক্ষেত্রে হোক বা যেকোনো ক্ষেত্রে কেউ জনপ্রিয় হলেই তিনি সুযোগ্য জনপ্রতিনিধি হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তার কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
আমাদের যেহেতু এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সেখানে বিভিন্ন পেশার অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যদি নির্বাচিত হন, তবে তা বরং ভালো। কোনো ক্ষেত্রে কেউ যদি হঠাৎ খ্যাতি অর্জন করেন এবং বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দেন, তাঁকে সেখানেই যোগ্যতম হয়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া উচিত। একটি ক্ষেত্রে যোগ্য হলেই রাজনীতিতে ভালো হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। ইমরান খান খেলা শেষ করে রাজনীতির খেলায় যোগ দিয়েছেন এবং দীর্ঘ সংগ্রাম করে রাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কারও হাত ধরে এমপি, মন্ত্রী হওয়াতে গৌরব নেই।
নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্যতর মানুষ দরকার। মুখ না চালিয়ে মাথা খাটাতে পারেন এমন ব্যক্তি চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি কমাতে হবে। অযৌক্তিক ব্যয় বাড়িয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে আরও হবে। এক সরকারের সময় দেখেছি খাম্বা ছিল তো বিদ্যুৎ ছিল না। এখন মানুষ দেখছে গ্যাস সঞ্চালনের পাইপলাইন আছে তো গ্যাস নেই। অবকাঠামো তৈরিতে টাকা ব্যয় হচ্ছে তো তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে অরাজকতা হয়েছে, জনগণের অর্থ যেভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে, টেকসই অর্থনীতির জন্য তা অশনিসংকেত। এক দিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। জনপ্রতিনিধিরা এই অবস্থার জন্য দায় এড়াতে পারেন না। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে আগামী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমনিতেই শিক্ষার মান নিম্নগামী। তার ওপর কায়েমি স্বার্থ গত কয়েক বছরে এমন সব অবাস্তব পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছে, যা জাতির জন্য অকল্যাণকর। এইসব কারবারে একটি গোত্র ধনকুবের হয়ে গেল। দুই দিন আগে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৩১ লাখ বাচ্চা ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় বসেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী বলেছেন, আগামীবার থেকে এ পরীক্ষা না–ও হতে পারে।
অর্থাৎ জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই পদ্ধতিই থাকবে না। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই পদ্ধতি চালু হলো কেন? শিক্ষা বিভাগের অব্যবস্থা ও দুর্নীতি রোধ করতে জনপ্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। শিক্ষাব্যবস্থার এই অবনতি রোধ করা না গেলে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকদের কাজ সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করা, বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করা নয়। বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করেন রাজনীতিকেরা। জনপ্রতিনিধিদের যদি বাস্তব বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা না থাকে তাহলে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন অসম্ভব। অন্যদিকে সুশিক্ষিত ও দক্ষ কূটনীতিবিদ ছাড়া ভালো বৈদেশিক নীতিও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা মানবতাবোধের পরিচয় দিয়েছি, কিন্তু কূটনৈতিক সাফল্য শূন্য।
গণতন্ত্রে রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতা পাবেন এবং হারাবেন। তাঁরাও জানেন যে তাঁরা স্থায়ী নন। আমলাতন্ত্র স্থায়ী। তারা যে স্থায়ী তারাও তা জানে। সে জন্য কোনো দলীয় সরকারকে আঁকড়ে থাকতে চায় না। যখন যে সরকার আসবে এবং যে সরকার বেশি সুবিধা দেবে তার হয়েই কাজ করবে। কাউকে বেশি সুবিধা দিয়ে হাত করলে প্রশাসনে বিভক্তি সৃষ্টি হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিলেই জনগণের যেমন উপকার, দলীয় সরকারেরও তাতে ক্ষতি নেই।
ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এসব বিষয় নিয়ে যাঁদের কাজ করার ক্ষমতা আছে, কেবল তাঁরাই সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য। সব দল প্রার্থী বাছাইয়ের সময় যোগ্যতর ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক