নির্বাচন নিয়ে চার বিশিষ্ট নাগরিকের মত
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরকারের
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক
নির্বাচন অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সে নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু হতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান উপাদান হলো দুটি। এক. আগ্রহী সব রাজনৈতিক দলের নির্বিঘ্ন অংশগ্রহণ। দুই. নির্বাচনে ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদান। এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হবে দুটি কারণে। এক. সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। দুই. সরকারি দলও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাই নির্বাচনে যাতে যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এটা নিশ্চিত করা না হলে বা নিশ্চিত করা না গেলে যে নির্বাচন হবে, তাতে যাঁরাই বিজয়ী হবেন, সে বিজয় কোনো গৌরব বয়ে আনবে না। তা ছাড়া, তেমন একটি নির্বাচনে বিজয়ী বা নির্বাচিতদের প্রতি জনগণের আস্থায়ও ঘাটতি পড়বে।
গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে জবাবদিহি। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সেই নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হন, জনগণের প্রতি তাঁদের জবাবদিহির ব্যাপার থাকে না। আর জবাবদিহি না থাকলে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার, সরকারি দল ও সব রাজনীতিকের উচিত হবে এই বিষয়গুলো মনে রাখা এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সেসব পদক্ষেপ নেওয়া না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। আর সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ইসি কতটা প্রস্তুত বোঝা যাচ্ছে না
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। অর্থাৎ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রাক্–প্রস্তুতিতে কিছু ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে। এই ঘাটতিগুলো পূরণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কতটা প্রস্তুত, তা–ও বোঝা যাচ্ছে না।
আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতীয় সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করা। নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকার ফলে বর্তমান সাংসদদের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করতে কমিশনকে কিছুটা বেগ পেতে হতে পারে।
নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণও আগামী নির্বাচনে আগের তুলনায় কঠিনতর হতে পারে। এ বিষয়ে একটি কমিটি বা কাউন্সিল করার পরামর্শ নির্বাচন কমিশনের সামনে ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। অবশ্য এটা করা হলেই যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যেত, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়তো সম্ভব হতো।
আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। সাধারণ প্রশাসনের প্রয়োজনের সময় সহায়তাকারীর ভূমিকা থাকবে সেনাবাহিনীর। কিন্তু পুরো বিষয় বা প্রক্রিয়াটি নির্বাচন কমিশনের আওতায় থাকবে, নাকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।
সংলাপে যা-ই হোক না হোক, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তুলনায় আগামী নির্বাচন সামনে রেখে একটা আপাতস্বস্তিকর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় আছে। এই অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলেই ধারণা করা যায়। যদিও তফসিল ঘোষণা নিয়ে তারা কিছুটা আপত্তি তুলেছে।
তফসিল ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের রুটিন কাজ। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশন একটা হিসাব করেই তফসিল ঘোষণা করে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত কিছুটা নমনীয়তা রাখা হয়, যাতে প্রয়োজনে কিছুটা পরিবর্তন করা যায়। সবাই নির্বাচনে এলে তফসিল পরিবর্তন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কোনো সমস্যা নয়।
সুষ্ঠু নির্বাচনের মন নিয়ে কেউই সংলাপে বসেননি
এ বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকার কথা নয় যে দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ তেমন একটি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি যে সংলাপ আমরা দেখলাম, তা কোনো উপসংহার ছাড়াই শেষ হলো। এর কারণ, আমি মনে করি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংলাপের মন নিয়ে কোনো পক্ষই সংলাপে বসেননি।
সংলাপে উভয় পক্ষই নিজ নিজ দাবি ও বক্তব্যে অনড় ছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির যে দাবি তোলা হয়, তাঁরা শেষ পর্যন্ত সেই দাবিতে ছিলেন অবিচল। আবার সরকারপক্ষ এর কোনোটিই না মানার ক্ষেত্রে ছিলেন অটল। ফলে সংলাপ শেষ হলেও সংলাপের আগের মতভেদ রয়েই গেছে।
আর একটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল সংলাপেও সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ। সংলাপের আগে আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে এসেছি যে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। এরপর হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী যখন রাজি হলেন, তখনই সংলাপ হলো।
অনেকে আশা করেছিলেন, এই সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে একটা সহমত তৈরি হবে। সব পক্ষই মনে করবে যে সংলাপে তাঁরা তাঁদের কথাগুলো মন খুলে বলতে পেরেছেন। তার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা আপসরফা হবে। কিন্তু তা যে হলো না, সেটাও অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, এক পক্ষের নিয়ন্ত্রণে যখন সবকিছু হয়, তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
সংসদ রেখে নির্বাচনে প্রত্যাশা পূরণ হবে না
দেশের নাগরিকদের এখন প্রধান প্রত্যাশা একটি ভালো ভোট। প্রতিযোগিতামূলক ও অবাধ নির্বাচন। এ ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয় দুটি—সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার তফসিল ঘোষণা। এটা করলেই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে সংসদ বহাল রেখে ২৩ ডিসেম্বরের নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে না।
ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ায় কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রাজনীতির মাঠে চলে এসেছেন। বিএনপির রাজনীতিও কিছুটা গতি পেয়েছে। এতে ভোটের মাঠে যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ও ভারসাম্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা ইতিবাচক। সরকার কয়েক মাস ধরে সংলাপের প্রস্তাব আমলে না নিলেও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে যে সংলাপ হলো, তা-ও ইতিবাচক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব বিচারেই দেশের রাজনীতিতে এই ইতিবাচক প্রবণতা এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যাবশ্যক।
সংলাপের মাধ্যমে এই ইতিবাচক পথেই রাজনীতি এগোচ্ছিল। এই অবস্থায় হঠাৎ তফসিল ঘোষণা সুষ্ঠু ও অংশীদারত্বমূলক নির্বাচনের অন্তরায় হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা-ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের সন্দেহের ইঙ্গিত দেয়।
সংলাপে ফল আসেনি ভেবে অনেকেই নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু সংলাপ যে হয়েছে, সেটাই সংলাপের সাফল্য। আর রাজনৈতিক সংলাপ কোনো সালিসি নয় যে সেখানে একটা সমাধান হবেই। রাজনৈতিক সংলাপের সালিসদার হচ্ছেন জনগণ। তাঁরা ভোটের দিন সেই রায় দেবেন।