জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিরোধী দলগুলোর আপত্তি আমলে না নিয়ে নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ ঠিক করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। তবে নির্বাচন নিয়ে যে দেশে একটি সংকট চলছে, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা মৃদু স্বরে হলেও তা স্বীকার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিরোধ আছে, তা রাজনৈতিকভাবেই মিটিয়ে সবাইকে নির্বাচনে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে যে কথাটি সিইসি এড়িয়ে গেছেন, তা হলো নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় কমিশনেরও দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব তারা পালন করলে সংকট আগেই কাটানো সম্ভব হতো। কমিশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই ক্ষমতাসীনেরা সব সময় নির্বাচনে জবরদস্তি করে থাকে। কমিশনাররা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে সেটি তারা করতে পারত না। নির্বাচন নিয়ে এত সংঘাত হতো না।
গত বৃহস্পতিবার সকালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বৈঠক থেকে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনার যেভাবে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন, তাতে মনে হয়, তফসিলের বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিল না। এর আগে ছোটখাটো বিষয়ে তাঁদের মধ্যে অনেক মতান্তর ও মনান্তরের ঘটনা ঘটলেও আমরা ধারণা করতে পারি, ইসি সর্বসম্মতভাবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে ডিসেম্বরে দুটি নির্বাচন হয়েছে ১৯৭০ ও ২০০৮ সালে। দুটিই সুষ্ঠু হয়েছিল। এবারের নির্বাচনটি কেমন হবে, আগাম বলা কঠিন। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে এ নির্বাচনে আর যা–ই হোক, ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা ঠেকাতে সরকারের প্রথম হাতিয়ার জাতীয় পার্টি, দ্বিতীয় হাতিয়ার অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, তৃতীয় হাতিয়ার ইসলামি দলগুলো। তারা সবাই বর্তমান সরকারের অধীনে, ঘোষিত তফসিলে নির্বাচন করতে এক পায়ে খাড়া আছে বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এখন যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দুই দফা সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি যেখানে ‘আশ্বাস’ ছাড়া কিছুই পায়নি, সেখানে তারা নির্বাচনে যাবে কি না। এ নিয়ে বিএনপির ভেতরে, জোটের ভেতরে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দেশের সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও সরগরম আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু হাতে তাদের খুব বেশি সময় নেই। আগামী নির্বাচনে যাওয়া বিএনপির জন্য যত না বড় কঠিন, নির্বাচনে না যাওয়া তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যে দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলকেও সরকার পাত্তা দেয় না, সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, সে দেশে বিরোধী দলবিহীন সরকার কতটা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হতে পারে, তার প্রমাণ ২০১৪ সালের আগের ও পরের সরকার; যদিও মন্ত্রিসভা ও সংসদের চেহারায় খুব বেশি অদলবদল হয়নি।
বিএনপি যখন সংলাপে সরকারের কাছ থেকে সাত দফার একটিও আদায় করতে পারেনি, তখন নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা জাগা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই সংলাপ থেকে বিএনপি কিছুই অর্জন করতে পারেনি, তা–ও বলা যাবে না। সরকারের যেই মন্ত্রী-নেতারা হরহামেশা কোনোভাবেই বিএনপির সঙ্গে বসতে রাজি ছিলেন না, তাঁরাই দুই দফা বৈঠক করেছেন। আনুষ্ঠানিক আলাপ শেষ হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ফের বসতে চেয়েছেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিএনপি এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তৃণমূলের বহু নেতা-কর্মী হয় জেলে, না হয় পলাতক আছেন।
এই চরম প্রতিকূল পরিবেশেও যে নেতারা মাথা ঠান্ডা রেখে সরকারের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ও আকুতির কথা দেশবাসীকে জানিয়েছেন, দলের কোনো কর্মী কোনো পর্যায়ে কেউ এখন পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খলতা দেখাননি, সে জন্য তাঁরা ধন্যবাদ পেতে পারেন। এতে দলটির প্রতি মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি বেড়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই সরকার বিএনপিকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, তাতেও তাদের দাবিগুলো অযৌক্তিক প্রমাণিত হয় না। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও অনুরূপ দাবি তুলেছিল। অন্যদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না, কারও বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া হবে না বলে সরকার যে আশ্বাস দিয়েছে, সেটি রেকর্ড হিসেবে থাকবে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা হবে না, সবাই সমান সুযোগ পাবেন ইত্যাদি বলেও প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীরা যে ওয়াদা করেছেন, ভবিষ্যতে তা প্রতিপালিত হয় কি না, সেটিও জনগণ বিচার করবে। আমরা মনে করি, সংলাপের লাভ–ক্ষতির মতো নির্বাচনের লাভ–ক্ষতির বিষয়টিও জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। আর সেটি নির্বাচন বর্জন বা প্রতিরোধ করে সম্ভব নয়; করতে হবে নির্বাচনে অংশ নিয়েই। এমনকি বিএনপি যদি খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনও করে, নির্বাচনের বাইরে থেকে তা সম্ভব হবে না।
সিইসি যেদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে বলে ঘোষণা দিলেন, সেদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকায় এসেছেন উচ্চ আদালতে জামিন নিতে। গ্রেপ্তারের হাত থেকে রেহাই পেতে। এর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার ঢাকার প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলেছিল, পুলিশ কয়েক শ মানুষকে ধরে রিমান্ডে নিয়েছে। এসব যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নমুনা হয়, তাহলে নির্বাচনের চিরাচরিত সংজ্ঞাই বদলে দিতে হয়।
সিইসির ভাষণের পর বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, স্বাভাবিক। তাঁরা সরকার ও ইসিকে তফসিল পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পরপরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হলো, না, ওই দিনই তফসিল দিতে হবে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের দেউলিয়াত্বই প্রকাশিত হলো। তফসিল এক দিন পিছিয়ে গেলে সরকারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি আবেগ কাজ করতে পারে যে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে কীভাবে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন? ১৯৮৩ সাল থেকে তাঁর নির্দেশ ও নেতৃত্বেই দলটি চলে আসছে। তিনিই এই দলের প্রধান হিসেবে দুবারে ১০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। কিন্তু আবেগ ও বাস্তবতা এক নয়। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতা যখন কারাগারে, তখনো দলটি নির্বাচন বর্জন করেনি। বিএনপি নেতৃত্বকেও বুঝতে হবে, এই মুহূর্তে নির্বাচনের বিকল্প কোনো পথ তাঁদের জন্য খোলা নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যদি তাঁরা আন্দোলন করতে চান, সেটিও করতে হবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে। নির্বাচন নিয়ে সরকার যেসব কথা বলেছে, নির্বাচন কমিশন অঙ্গীকার করেছে, তারা সেগুলো রাখে কি রাখে না, সেটা প্রমাণ করার জন্যও বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে।
এ কথা ঠিক যে সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে তাঁর কারাবাস স্থায়ী করতে চাইছে। যদিও সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার জামিন বা মুক্তি আদালতের বিষয়। এ ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই। আইন বরাবর একই গতিতে চললে নাজমুল হুদা উচ্চ আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না। আবার সরকারি মহল থেকেই খালেদার ‘প্যারোলে মুক্তির’ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে; যদিও বিএনপি বলছে, তারা প্যারোলে মুক্তি চায় না, জামিন চায়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিল। তিনি রাজি হননি।
এবারও যদি খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি না নিতে চান, তাহলে হয়তো তিনি শিগগিরই ছাড়া পাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রেও বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে যাওয়া। নির্বাচনের বাইরে থেকে তাঁরা কোনো সভা–সমাবেশও করতে পারবেন না। সরকার করতে দেবে না।
তাই তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের আবেগ ও অনুভূতি যতই প্রবল হোক না কেন, বিএনপির নেতাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা তো বটেই; দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থেও বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি