ফেসবুকে কয়েকটা ছবি খুব ‘ভাইরাল’। মাদ্রাসার ছাত্ররা ছবি তুলছে রাজু ভাস্কর্যে, অপরাজেয় বাংলা আর শহীদ মিনারে। ঘুরে দেখছে ডাকসুর সংগ্রহশালা। অনেকে অবাক: এসব তো ‘আমাদের’, ওরা তো ‘অন্য রকম’! ‘আমাদের’ এত কাছে চলে এসেছে ‘ওরা’! অন্যভাবেও তো দেখা যায়। ওরা ‘আধুনিক ও প্রগতিশীল’ ঐতিহ্যেরই অনুকরণ করছে, সেসবের কাছেই আসতে চাইছে। সঙ্গে পাস করতে চাইছে মাস্টার্স, চাইছে ‘স্বাধীনতা পদক’। ওদের ‘আধুনিক’ হতে চাওয়ার মধ্যে কি ‘আমাদের’ সমান হওয়ার তাগিদ নেই? আমরা আধুনিক ‘অসাম্প্রদায়িক’ ‘সচ্ছল কনজ্যুমার’ ও ‘নান্দনিক’ থাকতে ভালোবাসি, এসব ভূমিকায় চলে বা পারফর্ম করে কৃতার্থ হই। ওরাও তা চাইতে পারে। দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা বলে সমাজের দুই তীরের মধ্যে সেতু গড়া যাবে না?
ক্ষমতাসীনেরা হয়তো ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেতুই পাততে চাইছে। কওমি সনদের স্বীকৃতি, মতপ্রকাশ বিষয়ে হেফাজতের দাবি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাখা, আদালত চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানো এবং ‘মদিনা সনদে’ দেশ চালানোর অঙ্গীকারে তা-ই বলে। তবে রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনের আবহে এই সেতুবন্ধ পুরোপুরি নিরীহ না। শাপলা চত্বরে বলপ্রয়োগের আগে-পরে হেফাজত সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য বর্তমানের বিপরীত। কী ঘটল এর মধ্যে?
সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠিত হওয়ার জবাবে হেফাজতের সঙ্গে দোস্তালি দিয়ে আওয়ামী লীগ পাল্লা ভারী করতে চাইছে। সরিয়ে রাখতে হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কার্ডটি। শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গী-সাথিরা এতে অসন্তুষ্ট। যে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী সরকারের মুখপানে চেয়ে থাকে, ভোটের নদী পার করিয়ে দেওয়ার তাকত তাদের নেই। বরং স্ববিরোধ আর পক্ষপাতে তাদের প্রভাব ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রের খুঁটিগুলো ক্ষমতাসীনদের হাতে থাকলেও সামাজিক খুঁটির অভাব দেখা যাচ্ছিল। হেফাজত সেই বিকল্প সামাজিক খুঁটি। হেফাজতকে দেওয়া জাগতিক সুবিধার বিনিময়ে পাওয়া রাজনৈতিক আনুগত্য তাই লেনদেনের বিষয়।
সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোটা সংস্কার ও কিশোর আন্দোলন দমন এবং নাগরিকদের ধরপাকড় সরকারের নৈতিক বর্মে চিড় ধরিয়েছে। বাড়তি চাপ হিসেবে এসেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কাজেই আওয়ামী লীগের চাই নতুন নৈতিক মোড়ক, হেলমেট বাহিনীর পাশাপাশি চাই অর্গানিক একটা গোষ্ঠীর ঢাল। পশ্চিমাদেরও বোঝানো দরকার, গতকালের জিহাদিদের যেভাবে বশ করেছি; অতএব, ক্ষমতার যোগ্য আমরাই। শাহবাগের দুর্নাম করায় শাপলার সাফল্যের খেসারত হিসেবে সরকারকে ধর্মমনা ভাবমূর্তি দেখাতেই হতো। বিরোধীদের আন্দোলন থেকে আত্মরক্ষায় ধর্ম ব্যবহারের এই কৌশল এরশাদও নিয়েছিলেন। পরিহাস এই, আওয়ামী লীগ যতই ধর্মাশ্রিত রাজনীতিকে কোলে তুলবে, বিএনপির সঙ্গে আদর্শিক দূরত্ব ততই কমবে। একসময় আওয়ামী লীগ দাবি করত, তারাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ‘স্ট্যান্ডার্ড’। এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপিই তাদের স্ট্যান্ডার্ড। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির আসল সূত্র। ক্ষমতার স্বার্থে এই রাজনীতি যে কারও সঙ্গে ঐক্য গড়তে পারে। শ্রেণি বা আদর্শের নিরিখ এই রাজনীতি মানে না।
এর নিরিখ হলো দলীয় প্রধানের একমেবাদ্বিতীয়ম অবস্থান। তিনি জোটের ভেতরে বিভিন্ন ধারার কোয়ালিশনের বিন্যাস ইচ্ছামতো বদলাতে পারেন। এই অদলবদলে আদর্শ নয়, কোয়ালিশনের ক্ষমতায় থাকাই আসল। জামায়াতের তাই লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করলেও পরে বিএনপির সঙ্গে সরকারে বসতে বাধে না। শেরেবাংলাও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে ঐক্য করার পরেই যোগ দেন মুসলিম লীগে। আওয়ামী লীগ একাত্তরের পর থেকেই একবার বাম, একবার ডানে পেন্ডুলামের মতো দুলেছে। জিয়া বাম ও ডান উভয়ের সঙ্গেই দলের ভেতর-বাইরে কোয়ালিশন করেন। এরশাদও করেছেন, খালেদা জিয়াও ভিন্ন নন। যখন যাকে দরকার তাকে কাছে টানো। কিন্তু এ ধরনের চর্চা রাজনীতিতে সুবিধাবাদকে পাকাপোক্ত করে।
এই রাজনীতি দুটি হিস্টোরিক ব্লকের বা ঐতিহাসিক জোটের শামিয়ানা ব্যবহার করে আসছিল: মুক্তিযুদ্ধ বনাম ইসলাম ব্লক তথা ’৭১ বনাম ’৪৭ তথা শাহবাগ বনাম শাপলা। ২০১৩ সালে দুয়ের সংঘাতে দুর্বল হয় উভয়ই। সেই সুযোগে দুটিকেই ফোলানো বা দমানোর ক্ষমতা চলে যায় শাসকগোষ্ঠীর হাতে। ক্ষমতার কাছে চেতনা ও আদর্শ হাতের তাসমাত্র। গণতন্ত্রে জনগণ শাসক বদল করে, অগণতন্ত্রে শাসকেরাই বদলে দেয় জনগণ। শাহবাগের সমাবেশের জায়গায় শাপলার জমায়েত বেছে নেওয়া দিয়ে বোঝা যায় কোন ধরনের তন্ত্রে আমরা আছি। এই রাজনীতির দুটি কেন্দ্র দুটি পরিবার, দুটি হিস্টোরিক ব্লক এবং দুই দলের নামে দুটি কোয়ালিশন। দুই পরিবারের অতীত অবদানের জন্য তাদের প্রধানেরা নিজ নিজ কোয়ালিশনের সব অংশের (ফ্যাকশন) কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য পান। তবে একটা শর্ত থাকে: দলীয় প্রধান ফ্যাকশনগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বেঁটে দেবেন এবং নিজ গোষ্ঠীর তালুকদার-জমিদারদের প্রতিযোগিতায় নিরপেক্ষ থাকবেন। মৌচাকের রানির মতো তাঁদের এই ভূমিকার জন্য দলগুলো ভেঙে পড়ে না।
যাহোক, আমরা শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য সামাজিক চুক্তি চাইলাম, পেলাম প্যাট্রন ও ক্লায়েন্টের (মুরব্বি ও উমেদার) মধ্যে লেনাদেনার চুক্তি। ৭ মার্চের যে ময়দান ‘জাতির জনকের’ কিংবদন্তির মঞ্চ; সেখানেই ঘোষিত হলো ‘কওমি জননী’ খেতাব। হেফাজতের দিক থেকেও এই আপস ‘যৌক্তিক’। তারা তাদের সমর্থক গোষ্ঠীকে নিরাপদ ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেই পারে। ব্যাপারটা দুনিয়াবি লাভ-লোকসানের নিরিখে স্বাভাবিক হলেও এতে উভয়েরই আদর্শিক কপটতার কথাই রটে গেল। ২০১৩ সালের হেফাজত যাদের সহানুভূতি পেয়েছিল, তাতেও ফাটল ধরল। এই দ্বিচারিতায় আওয়ামী লীগ ও হেফাজত শিবিরে গৃহবিবাদ বাড়তে পারে।
বাঙালি ও মুসলিম পরিচয় এখন অবধি বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র। আমাদের ইতিহাসের দুটি হিস্টোরিক ব্লক। এ দুয়ের কোনো এক পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেলে ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। তাতে পাকিস্তানের মতো অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি থাকে। লাভের গুড়ের ভাগাভাগির বদলে দুই পক্ষের আন্তরিক সংলাপই দরকার। দরকার জাতি বা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক পরিচয়ের রাজনীতির বাইরে এসে সবাইকে নাগরিক হিসেবে সমান ভাবার বাস্তবতা। সেই নিশ্চয়তা দূর অস্ত হলেও পরিচয়ের রাজনীতি ফিকে করায় হেফাজত ও আওয়ামী লীগের এই আপস ভূমিকা ফেলতে পারে। হেফাজত আওয়ামী লীগের নতুন ট্রাম্প কার্ড। ওদিকে কবি ভাবছেন, ‘খেলতে খেলতে না জানি ধুলা হয়ে যায় আমাদের খেলা!’
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]