শিক্ষাগুরু শাজাহান খান ও মুখে-কালি জনতা
আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং জল-স্থল ও আরও বহু তল-উপতলের পরিবহনশ্রমিকদের প্রাণের নেতা শাজাহান খান। নিহত শ্রমিকের জন্য বা শ্রমিকের নিহত সন্তানের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে না; বরং তিনি হেসে ওঠেন। কিন্তু যে শ্রমিক গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে পারেন, তাঁর নামে স্লোগান দিতে পারেন, তাঁদের আর কেউ না থাক, তিনি আছেন। কিশোর-কিশোরীদের বিক্ষোভের জন্ম হয়েছিল যে ছাত্রীটির মৃত্যুতে, তার বাবা ছিলেন একজন বাসচালক। তখন মন্ত্রী মহোদয় হেসেছিলেন। যখন কেরানীগঞ্জের এক পরিবহনশ্রমিক অন্যায্য টোল আদায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দিলেন, তখনো শ্রমিকনেতা কাম মন্ত্রী শাজাহান খান মুখ খোলেননি। এমনকি ফতুল্লায় যখন চার শ্রমিকের লাশ সড়কে চিত-কাত-উপুড় হয়ে পড়ে ছিল, তখনো তিনি সটান নীরব। কিন্তু যখন গণ-আন্দোলনের চাপে সরকার আগের থেকে কিঞ্চিৎ কঠোর সড়ক দুর্ঘটনা আইন করল, অমনি ঢাকার রাজপথে তাঁর অনুসারীরা পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বসল। শ্রমিকনেতা হয়েও তিনি বললেন, তিনি কিছু জানেন না। যাঁদের নিজস্ব গাড়ি আছে, তাঁরা সেটা নিয়ে বেরোলেন, আর যাঁদের সম্বল কেবল পা দু’খানি, তাঁরা তাতে ভর করেই কাজে বেরোলেন। এবং এই পদাতিকেরা অনেকেই পড়লেন ধর্মঘটি শ্রমিকদের রোষানলে। যখন রাস্তায় রাস্তায় তাঁর ‘সৈনিকেরা’ চালক ও যাত্রীদের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে নির্যাতন করছে, আশা করি সে ব্যাপারেও তিনি অজ্ঞান থাকবেন।
বিপ্লব ব্যর্থ হলে প্রতিবিপ্লব হয়, আন্দোলন ব্যর্থ হলে প্রতি-আন্দোলন ঘটে। নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের সড়কে নিরাপত্তা আন্দোলনে সসম্মানে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করাকে যদি শান্তিপূর্ণ বিপ্লব বলি, তাহলে যাত্রীদের মুখে কালি মাখানো প্রতিবিপ্লব। আশা করি, প্রতিবিপ্লবের জয় হবে এবং জনগণ মুখে কালি মাখা, তাড়া-খাওয়া চেহারায় নিজেদের আসল চেহারা দেখতে পাবে।
সেই চেহারা এ–ই: মুখ ফসকে বলা কথার জন্য আপনি জামিনের অধিকার হারিয়ে জেলে যাবেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃত অবহেলা অথবা বেপরোয়া দম্ভের বশে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেললেও চালককে জামিন দিতে হবে। শাস্তি হতে হবে ন্যূনতম ইত্যাদি। এখানে না বললে অন্যায় হবে যে আমাদের দেশের পরিবহনশ্রমিকেরা অমানবিক জীবন কাটান। গাড়ির ফিটনেস থাকবে না, চালককে প্রশিক্ষিত করানোর সুযোগে কমতি থাকবে, অযোগ্য ও মুনাফাভোগীদের কারণে সড়কে নৈরাজ্য চলবে, রাস্তা হবে ভাঙা অথবা চিপা; মাফিয়াতন্ত্র চালককে শুষে নেবে, হাজারো কোটি টাকার চাঁদা তুলে নেবে মাফিয়া নেতারা অথচ চালককে হতে হবে পৃথিবীর সেরা, এমন দাবি আমরা করি না। মানুষের মৃত্যুর লাইসেন্স দিয়ে রাখাও তো চরম নিষ্ঠুরতা। অপরাধ করলে শাস্তি হবে; এর বিরুদ্ধে কথা থাকতে পারে না। কিন্তু ওপরতলার দোষে নিচতলার যাত্রীরা গণহারে মরবেন, তবু চালকদের সাবধান করার জন্য আইনের শাসন রাখা যাবে না? এ কেমন বিচার? সুবিচার না হলেও এটাই ‘নিয়ম’ এখন বাংলাদেশে।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, কর্তা হাঁটালে হাঁটতে হবে, কাঁদালে কাঁদতে হবে। তবে গোপনে। মনের দুঃখে পরিহাসের হাসিটাও চেপে থাকতে হবে। ১৫-২০ জন নিয়ে দিনের পর দিন শাহবাগ মোড় অবরোধ করে পুরো রাজধানীকে ভোগালে ভুগতে হবে। এর মাধ্যমে জানতে হবে, কেমন বাংলাদেশে আমরা আছি এবং সেই বাংলাদেশ থাকতে হলে কেমন সহ্যক্ষমতা চাই। ক্লান্ত-বিরক্ত কিন্তু অসহায় মুখ করা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধদের সারি আজ রাজপথে অবলা হয়ে সহ্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। বাস নাই তাই একদল যাত্রী নাক চেপে ময়লা পরিবহনের গাড়িতে উঠে বসেছেন। যাঁরা ট্রাক বা রিকশাভ্যান পেয়েছেন, তাঁরা যেন চাঁদের যাওয়ার রকেট পেলেন। একটা দেশের সত্যিকার বাস্তবতা তুলে ধরে তার রাজপথ। রাস্তার রাজার বিপরীতে প্রজার দশাতেই বোঝা যায় দেশের জনগণের মর্যাদা ও অধিকারের আসল চেহারা। আমাদের কোনো জনপথ নেই, যা আছে তা রাজপথ। সেখানে প্রজাদের কোনো অধিকার থাকতে নেই। ক্ষমতার এই ধু ধু প্রান্তরে ঘাসের মতো জনতাকে পায়ে মাড়িয়ে যাওয়া যায়, কাটা যায়, ছেঁড়া যায়। আইন-সংবিধান-নৈতিকতা এই শিক্ষাটাই বারবার আমরা পাচ্ছি। ক্ষমতাহীনের জন্য এই শিক্ষাটাও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি।
ছাত্র আন্দোলনে মিথ্যা মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল আমাদের কজনকে। সেটা ২০০১ সাল, বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সে সময় জেলের সহকয়েদি ও হাজতিরা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ভুলে যান, জেলখানাই হলো আসল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আপনি পাস তো সবখানেই পাস। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় টিকে থাকার পরীক্ষাই আসল পরীক্ষা। এই জীবন এক কড়া শিক্ষাসফর। কীভাবে বোবা থেকে, সব প্রতিকূলতা সয়ে, চেনা-অচেনা বিপদ ও আঘাত মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হবে, আমরা সেই শিক্ষা হাড়ে-মনে পাচ্ছি।
প্রথম শিক্ষা হলো জোর যার মুলুক তার। বলপ্রয়োগই এখানে রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রধানতম ভাষা। এই ভাষার প্রিয় প্রবাদ হলো: মাইরের ওপর ওষুধ নাই। বলপ্রয়োগ সব সময় করে দেখাতে হয় না, ভয়টা জাগিয়ে রাখাই যথেষ্ট। বল প্রয়োগ সব রাষ্ট্রই করে থাকে। কিন্তু প্রতিদিনের রাষ্ট্রকাজে, প্রতিটি ঘটনায় যেখানে বলপ্রয়োগই ক্ষমতাবানদের প্রধান ব্যবহার, সেই দেশ, সেই সমাজ, সেই রাষ্ট্র আদিম শিকারি জীবনের থেকে বেশি আগাতে পারেনি। এখানে সর্বদাই আপনাকে শিকারি থাকতে হবে, নয়তো শিকার হওয়ার ভয় নিয়ে চলতে হবে।
সহপাঠীর মৃত্যুর বিরুদ্ধে কিশোর প্রাণেরা যে দাবি তুলেছিল, সেটা ছিল গণতান্ত্রিক সামাজিক আন্দোলন। তার জবাবে শ্রমিকেরা যেটা করছে, তাকে বলে সংগঠিত বলপ্রয়োগ। তারা গাড়ি চলতে দিচ্ছে না, অনেক জায়গায় উবার-পাঠাও সার্ভিস আটকাচ্ছে, তারা মানুষকে হাঁটতে বাধ্য করছে। কারণ, জনগণ আজ বলহীন। জনগণের পক্ষের শ্রমিক-ছাত্র-পেশাজীবী বা রাজনৈতিক দল ছত্রভঙ্গ ও নিস্তেজ। এই শ্রমিকেরাই যদি মজুরির দাবি তোলে বা চায় মানুষের মতো জীবন, তাহলে তাদেরও ফতুল্লার শ্রমিকের মতো পরিণতি পেতে হতে পারে। সুতরাং এটা শ্রমিকের ক্ষমতা না, এটা মাফিয়া নেতার বলপ্রয়োগের ক্ষমতা প্রদর্শন, এটা তাঁর দাম বাড়ানোর কৌশল। যদি রাজনীতিতে বল প্রয়োগই মুখ্য হয়, তা হলে শাজাহান খান ও শামীম ওসমানের মতো নেতারাই সেই রাজনীতিতে হবেন জনপ্রিয় নেতাদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।
কিন্তু কোনো বিবেকবান দূরদর্শী মানুষ বলবেন, শান্তি-সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গেলে, মানবিকতার চাষবাস অসম্ভব হয়ে গেলে যে বিরাট পথ খুলে যায়, তা অশান্তির, পাল্টা বলপ্রয়োগের। শেক্সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের সেই ইহুদি চরিত্রের সংলাপ তখন ভুক্তভোগীদের মনে জাগতে পারে, ‘আমাদের কি চোখ নেই? নেই হাত, অঙ্গ, ভাব, অনুভূতি, বোধ ও ভালোবাসা? তুমি-আমি একই খাবার খাই, আহত হই একই অস্ত্রে। একই অসুখে আমরা ভুগি এবং সেরে উঠি একই ওষুধে...একই গ্রীষ্ম ও শীত আমাদেরও ওম দেয় আর ঠান্ডায় কাঁপায়। তুমি যদি আঘাত করো, আমার কি রক্ত ঝরে না? তুমি যদি কৌতুক বলো, আমি কি হাসি না? এবং তুমি যদি অন্যায় করো, আমি কি তার প্রতিশোধ নেব না? সবকিছুতেই যদি আমরা তোমাদের মতোই হই, তাহলে তুমি যা আমার প্রতি করছ; আমিও তা-ই করব। হয়তো তা হবে তোমার থেকেও কঠিন, আমি তো তোমার কাছ থেকেই শিখছি।’
এমন শিক্ষা কেউ পাক, তা আমরা চাইতে পারি না। তাহলে কি প্রয়াত জনপ্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রেমের গানের মতোই ভাবতে হবে, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’। তুমি যদি স্যাডিস্ট হও, আমার তবে কষ্টসহিষ্ণু হওয়াই নিয়তি?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]