কয়েক দিন আগে ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম সাংবাদিকদের একটি কর্মশালায় যোগ দিতে। শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ল প্রায় প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে, মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন স্থাপনায় আওয়ামী লীগের নেতাদের ছবিযুক্ত বিশাল বিলবোর্ড, রং-বেরঙের পোস্টার, যার কোনোটিতে ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো, কোনোটিতে আগামী নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থিতা জাহির করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের পোস্টারের ভিড়ে জাতীয় পার্টির নেত্রী রওশন এরশাদের দু-একটা পোস্টার চোখে পড়লেও বিএনপির কোনো পোস্টার দেখা যায়নি। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে রওশন এই আসনের সাংসদ। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই আসতে পারছেন না, পোস্টার লাগাবেন কীভাবে? বিএনপির অফিস তালাবদ্ধ। কেন্দ্রীয় কোনো কর্মসূচি থাকলে ১০ থেকে ১৫ জন সমর্থক নিয়ে কোনো নেতা শহরের কোথাও একটি ঝটিকা মিছিল করেই দায়িত্ব শেষ করেন।
দেয়ালে, খুঁটিতে টানানো ছবিগুলো যতটা সুন্দর ও নান্দনিক, নিচের রাস্তাঘাটগুলো ততটাই অসুন্দর ও যন্ত্রণাদায়ক। সহকর্মী কামরান পারভেজকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখলাম, সেখানকার প্রতিটি সড়কই ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা। বহু বছর এসব সড়কে কাজ হয়নি। তদুপরি যানজট লেগে আছে। অতিসম্প্রতি কয়েকটি সড়কে সংস্কারকাজ শুরু হওয়ায় যাত্রীসাধারণের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। গাংনীর পারে অবস্থিত ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে যেতে হলো অনেকটা ঘুরে, খানিকটা হেঁটে। সংস্কারকাজের জন্য সড়ক বন্ধ।
সিটি করপোরেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে রাস্তাঘাটের দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দায় এড়িয়ে বললেন, বরাদ্দ ছিল না বলে কাজ করা যায়নি। এখন বরাদ্দ এসেছে, দ্রুত কাজ শেষ হবে। পাঁচ লাখ মানুষের একটি বিভাগীয় শহরের সড়কের অতি আবশ্যকীয় সংস্কারকাজ অর্থাভাবে বন্ধ থাকবে, এটা কী ধরনের কথা? কেবল শহরের সড়কগুলো খারাপ তা নয়, পার্শ্ববর্তী শেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, জামালপুরের সঙ্গে সংযুক্ত আন্তজেলা সড়কের অবস্থাও বেহাল। উন্নয়নের রোল মডেলের কোনো চিহ্নই দেখলাম না ময়মনসিংহে। চার লেনে সজ্জিত ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক থেকে শহরে যেতেই মনে হলো ‘প্রদীপের পাশে অন্ধকার’।
শুধু সড়ক নয়, নতুন বিভাগীয় শহর হিসেবে অনেক কিছুরই ঘাটতি আছে সেখানে। ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিভাগ ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, দ্রুততম সময়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে অত্যাধুনিক নতুন শহর, যানজট নিরসনে উড়ালসড়ক এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর আরও তিনটি সেতু নির্মাণ করা হবে। তিন বছর পার হলেও কোনো কাজ হয়নি। প্রথমে ব্রহ্মপুত্র নদের তিন কিলোমিটারের মধ্যে শহর নির্মাণ করার কথা থাকলেও পরে নকশা বদল করে ১৪ কিলোমিটার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি নিয়েই স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রবল আপত্তি।
তাঁরা বলেছেন, বর্তমান নকশা অনুযায়ী শহর হলে ১৭ হাজার পরিবার উচ্ছেদ ও শত শত একর ফসলি জমি বেহাত হবে। ময়মনসিংহ মুসলিম ইনস্টিটিউটে অবস্থানকালে বসতবাটি রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন তরুণ এসে বললেন, ‘আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে, তা মানা যায় না।’ জিজ্ঞেস করি, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছে আপনারা যাচ্ছেন না কেন? তাঁদের জবাব, ‘আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।’
প্রধানমন্ত্রীর ময়মনসিংহের আসার খবর-সংবলিত বিলবোর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলেন, এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো ঘোষণা ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তিন দফা তারিখ দিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। আর প্রচারে এগিয়ে ছিলেন ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মোহিতুর রহমান ওরফে শান্ত।
এরই মধ্যে ৩১ জুলাই খুন হন যুবলীগ নেতা শেখ আজাদ। কোনো গুপ্তহত্যা নয়। প্রকাশ্যে শেখ আজাদ ও তাঁর প্রতিপক্ষ ফরিদ শেখের অনুসারীরা আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা ইত্যাদি নিয়ে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করেনি। অনেকের অভিযোগ, পুলিশ পাহারার মধ্যে থেকেই প্রতিপক্ষ গ্রুপ আজাদকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে যা জানতে পেরেছি, তাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগের রাজনীতি ‘মন্ত্রী গ্রুপ’ ও ‘মেয়র গ্রুপে বিভক্ত’। ময়মনসিংহ যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য শেখ আজাদের রাজনৈতিক উত্থানও বিস্ময়কর। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর কিছুদিন একটি দরজি দোকানের সহকারী ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ভাই আফাজউদ্দিন সরকারের হাত ধরে। পরে তাঁর সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে মন্ত্রীপুত্র শান্তর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কয়েক মাস আগে তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে মেয়র ইকরামুল হক ওরফে টিটুর পক্ষ নেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে বাড়ি দখল, মাস্তানি ও চাঁদাবাজির গুরুতর অভিযোগ ছিল। পুলিশের খাতায় সন্ত্রাসীদের যে তালিকা, সেখানেও নাকি তাঁর নাম ছিল।
কিন্তু আজাদের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন সে কারণে তাঁর খুন জায়েজ হতে পারে না। দেশে আইন-আদালত আছে। তাঁর অপরাধের বিচার হতে পারত। বিচার হয়নি। এখন তাঁর হত্যার বিচার হবে-তা-ও ময়মনসিংহের মানুষ বিশ্বাস করে না। শেখ আজাদের পরিবার থেকে মন্ত্রীপুত্রসহ ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। অন্যদিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে’ ‘রাজাকার’ বলায় আজাদের স্ত্রী দিলরুবা আখতারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনিও উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নয়েছেন।
ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতারা এখন ব্যস্ত আজাদ শেখের হত্যা নিয়ে। কারও মাথায় নির্বাচন বা উন্নয়ন নেই। আজাদ হত্যার বিচার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চলছে বাদানুবাদ। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। আজাদ হত্যার বিচারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই হত্যাকে কেন্দ্র করে কোন গ্রুপ কীভাবে রাজনৈতিক সুবিধা নেবে।
ময়মনসিংহের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো যেখানে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেখানে আওয়ামী লীগ নিজেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। গতকাল প্রথম আলোয় ময়মনসিংহের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ও গফরগাঁওয়ের সাংসদ ফাহিম গোলন্দাজের কীর্তি-কাহিনি ছাপা হয়েছে। তাঁর অত্যাচারের ভয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগেরই অনেক নেতা এলাকাছাড়া। কেউ কেউ আক্রমণের শিকার হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই।
নির্বাচন নিয়ে ময়মনসিংহের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা যা বলেছেন, তাতে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। তাঁদের মধ্যে একধরনের হতাশা ও নির্লিপ্ততা কাজ করছে। নির্বাচন হবে কি হবে না, তা নিয়ে তাঁদের মনে সংশয় নেই। সংশয়টি হলো নির্বাচনটি কেমন হবে, কীভাবে হবে, ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন কি না। নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যে ভোটাররা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন। সবখানে ভয়, অস্থিরতা।
অনেকে বলছেন, এবারে ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন হবে না। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং সিলেটে সফল সমাবেশ করার পর এই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা তফসিল ঘোষণার আগেই ঘর গুছিয়ে নিতে চাইছেন। বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মহিমা প্রচার করছেন। কিন্তু সেই গুছিয়ে নেওয়া ঘরেই যে বিভীষণের তাণ্ডব শুরু হয়েছে, তার কিছু আলামত দেখে এলাম ময়মনসিংহে। অন্য স্থানের আলোচনা অন্য কোনো সময়ে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com