এমন সময় খবরটা পেলাম, যখন নরওয়ের অসলো শহরে এক কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম। মুঠোফোনে ফেসবুক ফিডে দেখলাম, আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন। মনে হলো চারদিকে সব থেমে গেল। থমকে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। বুকের ভেতরটা এমন মোচড় দিচ্ছিল, যেন আমার আপন কেউ মারা গেছে। কাঁদি না অনেক দিন। প্রচণ্ড বেদনা গ্রাস করল। বাচ্চু ভাইয়ের গানের ভাষায় ‘এই বেদনা যেন নীল বেদনা’। যে বেদনা আমার পৃথিবী ধূসর করে দিচ্ছে বারবার। বোবা অশ্রুতে চেতনা যেন নোনা হয়ে যাচ্ছে। কোনোমতে কষ্টকে গিলে ফেলে কাটখোট্টা কনফারেন্সের প্রথম দিন শেষে অশ্রুসিক্ত হয়ে লিখছি। আর ভাবছি, বাচ্চু ভাই কি এখন সত্যিই এক জন্মহীন নক্ষত্রের মতো জেগে থাকবেন?
তিনি তো নক্ষত্রই ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে কি কিছুটা নিবু নিবু হচ্ছিলেন? আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, আইয়ুব বাচ্চু একটা ভুল দেশে জন্ম নিয়েছিলেন। যেখানে দর্শক–শ্রোতা তাঁকে ঠিকমতো অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারেননি। এই নিয়ে তাঁর বোধ হয় একটা কষ্ট ছিল। গিটার বাজানোর দিকে তিনি নিঃসন্দেহে কিংবদন্তি গিটারবাদক জো-সেট্রিয়ানির কাছাকাছি ছিলেন। আর তিনি এমন সব ঘরানার কিছু রক গান গেয়েছেন, আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকে থেকে বৈচিত্র্যময় শ্রোতাকুল ঠিকমতো তাঁকে বুঝতে পারেননি। মনে পড়ে ২০১৬ সালে এলআরবির ২৫ বছর পূর্তি কনসার্টের কথা। আইয়ুব বাচ্চু বারবার দর্শকের অনুরোধের প্রেক্ষাপটে বলছিলেন, ‘প্লিজ, আজকে আমাকে আমার প্রিয় গানগুলো গাইতে দিন, আজকে আমার দিন।’ ওই দিন তিনি তাঁর কিছু প্রিয় হার্ড রক গান করেছিলেন, যেগুলো বাংলাদেশের বেশির ভাগ শ্রোতাই বুঝতে চাননি। এ কারণেই এলআরবির প্রথম দিকের অ্যালবামগুলোর যেমন এলআরবি ১ ও ২ ও তবুওর গান বাচ্চুর অন্য
জনপ্রিয় গানগুলোর মতো শহরে ও গ্রামে তেমন সাড়া ফেলেনি।
প্রথম দিকে আইয়ুব বাচ্চু হার্ড রক গান বেশি গাইতেন। তাই তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল শহরের কিছু শ্রোতার মধ্যে আবদ্ধ, যাঁরা নব্বইয়ের দিকে হার্ড রক শুনে অভ্যস্ত। ফকির, বাউল, ভাওয়াইয়া আর ভাটিয়ালির দেশে আজম খানের শুরু করা ব্যান্ডসংগীত তখনো জায়গা করে উঠতে পারেনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দিগন্তের মূল ধারায়। এ জন্যই এভাবে হার্ড রক গান করা অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ ছিল। বেশির ভাগ শ্রোতা প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা বদলের হাওয়া লেগেছে নব্বইয়ে কমিউনিজমের পতনের পরে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় পুঁজি হচ্ছে সংস্কৃতি। বাংলাদেশেও এ হাওয়াটা আস্তে আস্তে লাগছিল। সেই অর্থে বাচ্চু তাঁর শ্রোতাদের প্রস্তুত করছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম দিকের বড় রকমের সফলতার মধ্যে ছিল কষ্ট অ্যালবাম। সফট রকের কষ্ট অ্যালবামটা দেশের আনাচকানাচ, শহর কি গ্রামে বাজতে থাকে। ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি/ তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’ ঘুরেফিরে মানুষের মুখে মুখে। হোক সে রিকশাচালক, চা বিক্রেতা, কোটিপতি বা বহুজাতিক কোম্পানির ম্যানেজার। কষ্ট–এর এই বাজারমূল্য অনুধাবন করে বাচ্চু স্ট্র্যাটেজি বদলান। পরের বেশ কিছু অ্যালবামে রাখেন সফট রক আর হার্ড রকের মিশ্রণ। আর নিঃসঙ্গতা, কষ্ট, বেদনা হয়ে যায় তাঁর গানের এক স্থায়ী থিম। কার জীবনে নিঃসঙ্গতা ও কষ্ট নেই? বাচ্চুরও নিশ্চয় ছিল। সেগুলো কি তাঁর গানগুলোতে ফুটে উঠেছিল? হয়তোবা হ্যাঁ, হয়তোবা না।
তাঁর ‘অন্ধকার মানুষ’ গানটিতে খুঁজে পেয়েছি এক অন্ধকার মানুষের গল্প, যে একবুক কালো ব্যথায় গড়া। যে কিনা প্রতারিত আর অনন্ত একা, নিঃসঙ্গ এক বিবর্ণ ফানুস। সেই মানুষের স্বপ্ন কেউ বোঝে না। সেই মানুষটি অন্ধকারে থেকেও অন্তহীন স্বপ্ন খোঁজে। এই বুকভরা বেদনাযুক্ত মানুষটির গল্প আবার শুনতে পাই ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’ গানটিতে, যেখানে শুনতে পাই যে বুকভরা এক কষ্ট নিয়ে এক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাঁর সুরের বুকে কান্না লুকিয়ে থাকে, যাঁর চোখের কোণে নোনা ছবি আঁকে, যাঁর গল্প শুনে হয় আলোকিত উৎসব, কিন্তু গল্প বলা শেষে মানুষটি হয়ে যায় আঁধারের মতো নীরব। তাঁর সে হাহাকার ‘বোঝে না কেউ তো চিনল না, বোঝে না আমার কী ব্যথা চেনার মতো কেউ চিনল না এই আমাকে’ এখনো হৃদয় চিরে যায় সবাইকে।
তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেমের গানটি ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’। সেখানেও ফুটে উঠেছে বেদনাভরা ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক সম্পর্কের গল্প। যেখানে বাচ্চু বলছেন, নিঃসঙ্গ এক প্রেমিকের গল্প ‘কত রাত আমি কেঁদেছি, বুকের গভীরে কষ্ট নিয়ে। শূন্যতায় ডুবে গেছি আমি, আমাকে তুমি ফিরিয়ে নাও’। আকুলের মতো বলছেন, ‘তুমি কেন বোঝো না, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়।’ সম্পর্ক ভাঙার পরের এই নিঃসঙ্গতা, কষ্ট ও প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি সবারই চেনা। গানটি প্রকাশ করার পর প্রায় দুই যুগ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো যেন নতুন। অনেকটা একই রকম গল্প বাচ্চু আমাদের শোনান তাঁর ‘ঘুমন্ত শহরে’ গানটিতে। সে এক বিষাদগ্রস্ত মানুষের গল্প: এই রাতে যেসব প্রেম হারিয়েছে অকারণে, দরজার চৌকাঠের ওপরে যে নিশি ব্যস্ত মানুষ হয়ে বসে আছে সমুদ্র কোলাহলের মতো অবিরাম ক্ষণে। যাকে নগরের যত বিষাদ ভর করে, যে বিনিদ্র জেগে আছে এক রুপালি রাতে! স্বপ্ন অ্যালবামের আরেক গানে বলছেন, ‘এক জীবনে আর কতবার আমি কেঁদে যাব? এক জীবনে আর কতবার আমি ব্যথা পাব? এই জীবন শেষে আমার মরণ এসে দাঁড়াবে পাশে। তখনো বুঝি কেঁদে কেঁদে যাব।’ তবে বাচ্চুর ‘নীল বেদনা’ গানটি ছাড়িয়ে গেছে সব কষ্টের গানকে: ‘বুকভরা শুধু দুঃখেরই ক্ষত, বাউলের একতারার মতো, এই আমাকে শুধু কাঁদায়, নীল বেদনা ঘিরে রয়েছে আমায়, দূর অতীতের দুঃখ ডাকে আমায়।’
কখনো বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি, কেন উনি বেদনা ও কষ্টকে তাঁর গানের একটা স্থায়ী থিম বানিয়েছিলেন। তবে বোধ করি উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বাংলাদেশে মানুষের জীবনে নিঃসঙ্গতা আর দুঃখগুলো এই নগরের ইট-পাথরের ফাঁকে ফাঁকে অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে নেবে। নগরায়ণ, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতায়নের আবর্তে ব্যক্তির সুখ–দুঃখের, সম্পর্কের ভাঙা–গড়ার সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিচ্ছে। ঢাকায় এখন এক ঘণ্টায় এক তালাক হচ্ছে। মানে প্রতি ঘণ্টায় বদলে যাচ্ছে সুখের আর দুঃখের সমীকরণ। বাচ্চু বোধ করি বুঝতে পেরেছিলেন, আজকের আনন্দ কালকের হাহাকারে পরিণত হবে। তাই বলেছিলেন, ‘জীবনের সেই প্রান্তে দাঁড়িয়ে কান্না পেলে আর লুকাব না। হারিয়ে যাবার সেই হাহাকারে, নতুন করে আর কিছু চাইব না।’
কষ্টে ভরা লেখাটা শেষ করছি বাচ্চুর আরেকটা গান দিয়ে। যেখানে তিনি বলেছেন, উনি চলে গেলে আমরা উনার ভক্তেরা তাঁকে কীভাবে মনে রাখব।
‘তুমি ভালোবেসো, আমার ভালোবাসা! যখন কখনো আমি থাকব না, দুঃখ না–হয় তুমি পেলে সীমাহীন, তবুও তুমি ভালোবেসো আমায়।’ আপনার জন্য আমাদের ভালোবাসা অসীম, বাচ্চু ভাই। দুঃখে চোখ জ্বালা করছে সীমাহীন। তবু এই দুঃখের সীমাহীন স্রোতের মাঝে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। ভালোবাসা বাড়ছে। আপনি আমার কেউ না, কিন্তু আপনি আমার জীবনের বড় একটা অংশজুড়ে ছিলেন। আপনার চলে যাওয়ায় তাই আমি পরিণত হয়েছি এক বেদনায় আচ্ছন্ন মানুষের মতো। নীল বেদনা ধীরে ধীরে আমাকেও গ্রাস করছে।
মোবাশ্বার হাসান : নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট–ডক্টরাল ফেলো