প্রবাসীদের ভোটাধিকারের কী হবে?
এক.
অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যে দক্ষিণ এশিয়ার বর্ধিতাংশ মনে হয়। দেশটিতে বসবাসকারীর ৫০ ভাগের বেশি হয়ে গেছে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয়। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানান বিষয়ে এই তিন দেশের নাগরিকদের প্রতিযোগিতা আছে আমিরাতজুড়ে। সেই প্রতিযোগিতায় সম্প্রতি পাকিস্তানিরা এক দফা এগিয়ে গেল। প্রবাসে থেকেও তাঁরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ১৪ অক্টোবর পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১১টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৬টি আসনে উপনির্বাচন হয়। তাতে ভোটের সুযোগ দেওয়া হয় প্রবাসী নাগরিকদের। আরব আমিরাতের পাকিস্তানিরা অনেকেই উৎসবের আমেজে ভোট দিয়েছেন। অল্পসংখ্যক পাকিস্তানিই ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করেছিলেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই নিবন্ধন শুরু করে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন পাইলট প্রজেক্ট আকারে। পুরো উপমহাদেশের জন্য এটা একটা ভালো সূচনা এটা।
ভোট দেওয়ার আগে-পরে আমিরাতের পাকিস্তানি ভোটারদের উৎসাহ প্রমাণ করছিল, দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসীরা কেবল কষ্টার্জিত আয় দেশে পাঠিয়ে সন্তুষ্ট নন, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। অন্য সব নাগরিক অধিকারের মাঝে এর আবেগময় গুরুত্ব অত্যধিক। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে বিশ্বের প্রায় সব প্রবাসী পাকিস্তানি চাইলে ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
দুবাইয়ে পাকিস্তানিদের ভোট উৎসব এখানকার বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের জন্য চ্যালেঞ্জের কারণ হয়েছে। নিজ নিজ দেশের ভোটে অংশ নেওয়ার তীব্র প্রত্যাশা দেখা যাচ্ছে তাঁদের মাঝেও।
ভারতের প্রবাসী জনসংখ্যা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের প্রবাসীদের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রবাসী মানুষ প্রায় ৬০-৭০ লাখ। বাংলাদেশের প্রায় ৭০-৮০ লাখ। এই তিন দেশ মিলে সাড়ে তিন কোটি মানুষ রয়েছে বিশ্বের প্রায় দেড় শ দেশে। তিনটি দেশেই সরকারি হিসাবে প্রবাসীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তিন দেশের প্রবাসীদের মাঝেই শ্রমজীবীদের আধিক্য আছে। ফলে তাঁদের ভোটাধিকারের দাবির সঙ্গে শ্রেণি রাজনীতিরও রয়েছে গভীর যোগ।
বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য হিসাবে দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচনে উপমহাদেশের প্রবাসীরা গড়ে মাত্র ৫ শতাংশ দেশে এসে ভোট দেন। আর্থিক কারণে নাগরিক অধিকার প্রয়োগে প্রবাসীদের অনীহা আছে। ফলে বিদেশে থাকা এই মানুষদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন এ মুহূর্তে উপমহাদেশজুড়ে রাজনৈতিক সংস্কারের বড় এক অ্যাজেন্ডা। শ্রীলঙ্কায় ‘জাতীয় মানবাধিকার অ্যাকশন প্লান’-এ বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ এক করণীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা যৌক্তিক। কারণ এ রকম নাগরিকদের ভোটাধিকার আন্তর্জাতিক সব মানবাধিকার সনদের গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। এরই মধ্যে বিশ্বের ৭০ শতাংশ দেশ প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়ন করে ফেলেছে।
দুই.
পাকিস্তানের পর ভারতও প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে দ্রুত বাস্তব পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রবাসীরা যাতে প্রয়োজনে প্রক্সি ভোটারের মাধ্যমে ভোটের দিন মতামত দিতে পারেন, সে লক্ষ্যে সম্প্রতি ভারতে নির্বাচনী আইনে সংস্কার হয়েছে। এখন থেকে প্রতি নির্বাচনে প্রবাসী ভোটাররা নতুন প্রক্সির মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন। ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় ২৫ হাজার প্রবাসী ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য নিবন্ধিতও হয়ে গেছেন। দেশটির নির্বাচন কমিশন অনলাইনে আগ্রহী ভোটারদের নিবন্ধনে উৎসাহ জোগাচ্ছে প্রচার আন্দোলন চালিয়ে। যাঁদের ভারতীয় পাসপোর্ট আছে এবং অন্য দেশে নাগরিকত্ব নেননি, তাঁরা আগামী নির্বাচনেই নিজ নির্বাচনী এলাকার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করা যায়।
ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কেরালা ও পাঞ্জাবের প্রবাসীরা ভোটার হতে বেশি উৎসাহী। এর কারণ অবোধগম্য নয়। শিক্ষিতরাই জাতীয় ভোটযুদ্ধে শরিক হওয়াকে রাজনৈতিক কর্তব্য মনে করে। এরূপ প্রবাসীদের জোট ‘প্রবাসী ভারত’ বহুদিন থেকে ভোটাধিকারের আন্দোলন চালাচ্ছে। সর্বশেষ আইনগত সংস্কার তাদের আন্দোলনেরই ফল। তবে ‘প্রক্সি ভোটার’ব্যবস্থা ছাড়াও পোস্টাল ভোট এবং ই-ভোটসহ প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে রয়েছে নানা উপায়। বিদেশের কূটনীতিক মিশনগুলোতে বুথ খুলেও এই অধিকারের বাস্তবায়ন সম্ভব। বাংলাদেশে বসবাসকারী বহু বিদেশি এভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন হামেশা। তাঁরা এটা পারলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য না পারার কারণ নেই। এই প্রশ্নে জাতীয় অঙ্গীকার থাকলে কারিগরি সমাধান কঠিন নয়। তবে ‘জাতীয় অঙ্গীকার’ তৈরিও সহজ নয়।
যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক আন্দোলনের নেতারা দেশে এসে ২০১৩ সালে জনমত গঠনের পাশাপাশি সর্বোচ্চ আদালতে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন ভোটাধিকার চেয়ে। তাঁরা তখন যুক্তি দেখান, প্রবাসীদের জন্য প্রায় ১২০ দেশে বিভিন্ন ধরনের ভোটব্যবস্থা রয়েছে। যার মধ্যে আছে এশিয়ার ২০টি দেশও।
একই ধরনের যুক্তি ও আবেগ নিয়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে বাংলাদেশিদের কয়েকটি সংগঠন অনেক দিন ধরে সোচ্চার। যদিও দেশে তাঁদের দাবির বিষয়ে প্রচার নেই। কিন্তু বিশ্বের সব প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এটা প্রাণের দাবি। অনেক সময়ই বিদেশ সফরে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা প্রবাসীদের এই দাবি উসকে দিয়ে আসেন। কিন্তু দেশে এসে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক করণীয় ভুলে যান।
তিন.
২০০৮ ও ২০১৪ সালে দুই দফা আলাপ-আলোচনা হলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিসরে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারমূলক উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে অনেক রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে দাবি ও সুপারিশ দাখিল করেছিল। সরকারের মনোভাবও ইতিবাচক। সুতরাং এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
ভারতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল এইরূপ সংস্কারের বিরোধিতা করছিল। তারা মনে করছে, এর ফলে বড় এবং আর্থিকভাবে সবল দলগুলোর সুবিধা হবে। বিদেশে প্রবাসীদের মাঝে নির্বাচনী প্রচার চালানো ছোট দলগুলোর জন্য দুরূহ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ছোট দলগুলোও অল্প কয়েকজন দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে প্রচার-প্রতিযোগিতায় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। এ ছাড়া প্রচারযুদ্ধে কারও সুবিধা-অসুবিধার কারণে নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ভোটাধিকার হলো নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারের এক মৌলিক শর্ত।
বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নকাজে প্রবাসীদের জ্ঞানগত অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সামর্থ্য ব্যবহারের জোরালো তাগিদ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। নরেন্দ্র মোদি এবং ইমরান খান উভয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে নেমে পড়েছেন। ভোটাধিকারের বিনিময়ে ইমরান খান দেশের বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্পে প্রবাসীদের দান-অনুদানের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং এই আহ্বান ভালো কাজ করছে।
এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ভোটের প্রচারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। উভয় দেশে ভোটযুদ্ধ প্রায় বৈশ্বিক রূপ নিচ্ছে। বিদেশে অবস্থানকারী ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা ফেসবুক ও টুইটারে দেশের রাজনীতিতে দারুণভাবে সক্রিয়। ভারতে লোকসভার প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গড়ে প্রায় ১৮ হাজার প্রবাসী রয়েছেন। সংখ্যা হিসাবে এটা ছোট নয়। বিপুল এই প্রবাসী নাগরিকদের ভোটের আয়োজনে অন্তর্ভুক্ত না করার অবকাশ নেই। ইন্টারনেট যুগে নির্বাচনী যুদ্ধে তাঁদের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করারও সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হিসাবটি আরও উত্তেজক। যদি প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ৭০ লাখও হয়, তাহলে জাতীয় সংসদের ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় গড়ে প্রায় ২৩ হাজার প্রবাসী রয়েছেন। পুরো জনসংখ্যার ৪-৫ শতাংশ তাঁরা। নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, শরীয়তপুরসহ কিছু জেলায় প্রবাসী ভোটারের সংখ্যা বিপুল। ওই সব এলাকার নির্বাচনকে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল করতে প্রবাসীদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এতে পুরো নির্বাচনী চিত্র অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও জবাবদিহিমূলক হবে। দাবি হিসেবে এটা সংবিধানসম্মতও।
বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবাসীদের হিস্যা এখন প্রায় ৮ শতাংশ। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রাণভোমরা প্রবাসীদের আয়। প্রায় অধিকাংশ প্রবাসীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিনিয়োগ আছে দেশে। সুতরাং তাঁরা পরোক্ষে নানারূপ করও দিয়ে যাচ্ছেন। যাঁদের রক্ত-ঘামে একটি জনপদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নীতিনির্ধারণেও তাঁদের অভিমত থাকাই সংগত। এত বড় সংখ্যায় বাংলাদেশিদের ভোটব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত না করে সবার দাবিকৃত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ কীভাবে সম্ভব? নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে কেবল দু-একটি সেমিনার করে থেমে থাকার সুযোগ নেই। কয়েকটি দেশে পাইলট আকারে হলেও এবারের নির্বাচনেই প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক