এবারের নদীভাঙনের সর্বগ্রাসী রূপ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। গবেষকেরা এযাবৎ ধারণা করে এসেছেন, নদীভাঙন একটি মৌসুমি সমস্যা। কিন্তু এ বছর সে ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভাঙনের মৌসুম আর কাটছে না। কোনো কোনো এলাকায় মৌসুমি বিপদ ক্রমেই সাংবৎসরিক বিপদের রূপ নিচ্ছে। তা ছাড়া ভাঙন এখন আর আঞ্চলিক কোনো দুর্যোগও থাকছে না। এ বছর গড়াই থেকে শুরু করে বর্ষায় উন্মত্ত পদ্মা কি আড়িয়াল খাঁ, সন্ধ্যা কি গাবখান অথবা উত্তরের একদম চুপচাপ নদী ছোট যমুনা—কারোরই পাড় টিকছে না। ভেঙে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, কৃষিজমি, খেতখামার, হাটবাজার, অফিস-আদালত, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৮টি জেলা কম-বেশি নদীভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এসব জেলার ২৪১টি এলাকাকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তবে এ বছর ভাঙন আর চিহ্নিত এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না।
যেসব প্রতিষ্ঠান নদীর গতিপথ, ভাঙাগড়ার খোঁজখবর রাখে, পূর্বাভাস দেয়, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস) সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। সিইজিআইএসের তথ্য অনুযায়ী গত বছর শুধু যমুনা নদীর তীরেই ভেঙেছে ২ হাজার ২২১ হেক্টর জমি, ৩ হাজার ৫৯৩ কিলোমিটার বাঁধ ও ৬ হাজার ৮৪৩ কিলোমিটার সড়ক। ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৬টি হাটবাজার,২টি সরকারি অফিস, ৩টি বেসরকারি অফিস, ৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ২৭টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিলীন হওয়ার হুমকিতে ছিল। বলা বাহুল্য, এ বছরের ভাঙনে এসবের একটিও আর অবশিষ্ট নেই।
বরিশাল অঞ্চল থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, নদীভাঙনে পুরান হিজলা, চর মেমানিয়া, মৌলভীরহাট, গঙ্গাপুর, হরিনাথপুর, মল্লিকপুর, বাউশিয়া, বাহেরচর, হিজলা-গৌরনদী ও পালপাড়া গ্রামের কয়েক হাজার ঘর, ১০টি বিদ্যালয় এবং ৩টি হাটবাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে ওই সব এলাকার কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও ১২টি বিদ্যালয়-মাদ্রাসা ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে।
এদিকে যমুনা নদীর করাল গ্রাসে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল ঐতিহ্যবাহী চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয় ভবন নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিদ্যালয়টির ১ হাজার ৫০০ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ভেঙে গেছে বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা।
শরীয়তপুরের জাজিরা আর নড়িয়া উপজেলায় ভয়ানক ভাঙনের শিকার প্রায় সব বড় বড় ইমারত, ক্লিনিক আর বাগানবাড়ি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আর সেসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের হালহকিকত নিয়ে তেমন একটা প্রতিবেদন নজরে আসেনি। জেলার খোদ শিক্ষা কর্মকর্তাও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা সম্পর্কে উন্নয়ন ও ত্রাণকর্মীদের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেননি।
পাঁচটি বাংলা আর দুটি ইংরেজি সংবাদপত্রে গত ছয় মাসের নদীভাঙন–সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ২০০টি স্কুলপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা) হয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে, নয় বিলীনের ঝুঁকিতে থাকায় নিলাম হয়ে গেছে, কিংবা পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাঠদান অবশ্য সব ক্ষেত্রেই বন্ধ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন্ন নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনী (১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলবে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (শুরু হবে ১৮ নভেম্বর, শেষ হবে ২৬ নভেম্বর) শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে কমপক্ষে ১২ হাজার। এসব শিক্ষার্থী অনেকেরই পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তিত হয়েছে। অজানা-অচেনা দূরবর্তী গ্রাম বা গঞ্জে প্রতিদিন গিয়ে অথবা কারও বাড়িতে থেকে তাদের পরীক্ষা দিতে হবে। বাড়িঘর, জমিজিরাত, বিদ্যালয় হারানো এসব শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের অনেকের পক্ষে এই চাপ সহ্য করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। বাড়বে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি।
তাহলে এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উপায় কী? এই শিক্ষার্থীরা যাতে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে, সে উপায় খুঁজে পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছাকাছি কোনো বিদ্যালয় বা বাড়িতে তাদের থাকা–খাওয়া আর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা একদম অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আগ্রহী অভিভাবকদের যুক্ত করে এটা করা সম্ভব। অনেক গৃহস্থ আছেন, যাঁরা বিনা ভাড়ায় তাঁদের একটা ঘর ১০-১২ দিনের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি হবেন। দেখতে হবে বাড়িগুলোতে ল্যাট্রিন আর গোসলের ব্যবস্থা আছে কি না এবং সেটা মেয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার উপযোগী কি না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে টাকাপয়সার প্রয়োজন হতে পারে কি না। হলে তা কোথা থেকে পাওয়া যাবে। হয়তো খুব কম খরচে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিনা খরচে এই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু টাকাপয়সা লাগতে পারে। যেমন কোনো বাড়িতে একটি বা দুটি ল্যাট্রিন বা একটি অস্থায়ী গোসলখানা কিংবা রান্নার ব্যবস্থা করার জন্য টাকা লাগতে পারে। যেসব সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা–সংগঠন নদীভাঙন এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা তাদের বিবেচনায় পরীক্ষার্থী-সহায়ক এই কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের একটা অংশ সামাজিক দায়ভারমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয়ের কথা বলা আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ দায়িত্বে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে এই কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। তা ছাড়া পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের দুর্যোগ তহবিল থেকেও এই ব্যয়ভার মেটানোর ব্যবস্থা করা যায়।
ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় কর্মরত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় মানুষের দানের ভিত্তিতে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী এ ধরনের উদ্যোগে প্রতি পরীক্ষার্থীর জন্য খরচ হবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মাত্র। সেই হিসাবে মাত্র ৬০ লাখ টাকায় নদীভাঙনের শিকার শিশু–কিশোর শিশু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
মাঝপথে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য, দেশকে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের।
গওহার নঈম ওয়ারা: গবেষক ও ত্রাণকর্মী