তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান ও অপর একজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তলব করলেও তাঁরা হাজির হননি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে। কেউ অসুস্থ হলে তিনি সময় নিতে পারেন। কিন্তু অসুস্থ না হয়েও
যদি কেউ অসুস্থ হওয়ার ভান করেন, তাহলে মনে করতে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
মীর মশিউর রহমান যেদিন দুদকে চিঠি লিখে তিন সপ্তাহ সময় প্রার্থনা করেছেন, সেদিনই তিনি তিতাসের কার্যালয়ে গিয়েছেন দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করতে। তাহলে দুদকে পাঠানো চিঠির ভাষ্য সঠিক নয়? অসুস্থতার প্রমাণ হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই চিকিৎসকের সনদও পেশ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিতাসের এই শীর্ষ কর্মকর্তা একটি মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিতাসের এমডির পদাঙ্ক অনুসরণ করে উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এস এম আবদুল ওয়াদুদও অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদকের কাছে সময় চেয়েছেন। এই অসুস্থতা রহস্যজনক।
দুদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সময় প্রার্থনার আবেদন নাকচ করে পুনরায় হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশ তামিল না হলে আশা করি সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিদের প্রতি প্রতিষ্ঠানটি আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। দুদকের তলবে হাজির না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক আইনের ১৯(৩) ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। তিতাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ, সীমার অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন তাঁরা। এ ছাড়া তিতাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এই অনুসন্ধানের আওতায় রয়েছেন।
সম্প্রতি প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও সরকারি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অনেক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অসাধু মালিক পরস্পরের যোগসাজশে রাষ্ট্র তথা জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। পেট্রোবাংলার এক অনুসন্ধানে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে ৭৫ কোটি টাকার বেশি গ্যাস নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পেট্রোবাংলা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের তাগিদ দিলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। একটি প্রতিষ্ঠান ৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সুযোগ নিলে সব প্রতিষ্ঠান মিলে রাষ্ট্রের তথা জনগণের ক্ষতির পরিমাণটি সহজেই অনুমান করা যায়। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান তিতাস কোম্পানির ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শিল্পগ্রাহকের সংখ্যা ৪ হাজার ৬১০। তিতাসের গ্যাস-সংযোগ পাওয়া বেশির ভাগ কারখানা গাজীপুর অঞ্চলে।
সপ্তাহ দুই আগে প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হলেও তিতাস কর্তৃপক্ষ কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন আছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কীভাবে অসুস্থতার অজুহাত তুলে দুদকের নির্দেশনাও অগ্রাহ্য করলেন, সেই জবাবদিহি না চাওয়া দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার শামিল। তিতাসে উৎকোচের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং নতুন নয়। কিন্তু কেজি মেপে ঘুষ নেওয়ার নজির সম্ভবত এই প্রথম। আর এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শীর্ষ পদাধিকারেরা যে দায়ী, তা-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রথম আলো। এত কিছুর পরও যদি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তিতাসের দুর্নীতি কেবল তিতাসেই সীমিত নয়। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাই বা কী করছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব বলেছেন, তিতাসে গ্যাস চুরি হয়, এটি সবার জানা। কিন্তু ধরা না পড়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এবার তো হাতেনাতে ধরা পড়লেন। এরপরও যদি তাঁরা শাস্তির বাইরে থাকেন, বুঝতে হবে সরষের ভেতরেই ভূত আছে।