কিশোর আলোর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় দুই বছর আগে। শিশু-কিশোরদের এই ম্যাগাজিনটির জন্মদিন উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকার সেন্ট যোসেফ স্কুলের মাঠে। ভেতরে ঢুকেই দেখি স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টটা ফাঁকা। ভাবলাম, এত সকালে কি আর ছেলেমেয়েরা আসবে! দু–এক পা এগিয়ে আমার ভুল ভাঙল। বিশাল আয়োজন! বিরাট মহাযজ্ঞ! মাঠের চারদিকে স্টল। পুরোদস্তুর একটা মেলার আবহ। কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে এসে হাজির। একসঙ্গে এতগুলো হাসিখুশি মুখ দেখে মন ভালো না হয়ে উপায় নেই।
প্রায় পাঁচ হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থাপনা করছিল ছোট দুটি মেয়ে। দ্যুতি আর বিভা। ওদের জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলে নিশ্চয়ই আমার হাঁটু কাঁপত! কিন্তু ওরা এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার মানুষের মনোযোগ ধরে রাখল, অবাক হয়ে দেখলাম।
আমার কাছে মনে হয়, কিশোর আলোর ছেলেমেয়েদের মূল শক্তিটা এখানেই। ওরা ভয় পায় না। সব সময় ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করে। পড়ালেখা করে। খেলাধুলা করে। নাচে। গান গায়। চমৎকার ছবি তোলে। অসাধারণ সব ভিডিও বানায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মিলে বড় বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করে ফেলে। আমি কিশোর আলোর বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। ওরা এসে কখনো আমার কাছে পড়ালেখার চাপের কথা বলে না, অভিযোগ করে না। সমস্যা হলে ওরা বরং সমাধান খোঁজে। এই দক্ষতাটা ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার জন্য যতটা জরুরি, ভালো মানুষ হয়ে ওঠার জন্যও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ।
এই ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে ওদের যখন প্রশ্ন করা হবে, পড়ালেখার পাশাপাশি তুমি কী করেছ? ওদের কাছে বলার মতো অনেক কিছু থাকবে। ওরা বলবে, আমি কিশোর আলোতে লিখেছি, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, বড় বড় মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আমি তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ‘টিমওয়ার্ক’ কীভাবে করতে হয়, আমি খুব ভালোভাবে জানি। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হলে কিন্তু এই দক্ষতাগুলোই দরকার। স্কুল-কলেজের বই পড়ে এসব শেখা যায় না। কিশোর আলোর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই আমি বুঝতে পারি, পড়ালেখা ঠিকঠাক রেখে ওরা এবার পড়ালেখার বাইরের দুনিয়াটা আবিষ্কার করতে নেমেছে।
আজ কিআর জন্মদিন। ২০১৩ সালের এই দিন থেকে প্রতি মাসে প্রকাশিত হয়ে আসছে ম্যাগাজিনটি। কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার যেমন আনন্দ হয়েছিল, এখনো ম্যাগাজিনটা হাতে নিলে কেন যেন একই রকম অনুভূতি হয়। এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে যে সারা দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যুক্ত, ওরা কিশোর আলো পড়ে, কিশোর আলোতে লেখে, পাতা ওলটালেই কেন যেন সেটা টের পাওয়া যায়।
জামিলুর রেজা চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার যেমন সব সময় সহশিক্ষা কার্যক্রমের গুরুত্বের কথা বলেন। আমরা বলি, বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। সবার ছাত্র হওয়া কিন্তু খুব কঠিন কাজ। কিশোর আলোর জন্মদিনে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে গিয়ে আমি দেখেছি, খুব আগ্রহ নিয়ে ওরা মানুষের কথা শোনে। নাচ-গান ওরা উপভোগ করে। আবার যখন কোনো লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, খেলোয়াড় বা তারকা মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, তখনো হাততালি থামতেই চায় না। শেখার আগ্রহ একটা অসাধারণ ব্যাপার। কিশোর আলো ছেলেমেয়েদের সিলেবাসের বাইরে নিয়ে যায়। ওরা গল্প পড়ে, কবিতা পড়ে, ছবি আঁকে। একটা সৃজনশীল মন তৈরি হয়। আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে লেখা ছাপা হয় বলেই ওরা পড়ে। পড়তে পড়তে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। যেটা সারা জীবন ওদের কাজে লাগবে।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, কেউ কিন্তু এসে আমার মা-বাবার কাছে জানতে চায়নি, এসএসসিতে আপনার ছেলে কি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছিল? কেউ বলেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার ছেলের সিজিপিএ কত? বরং বলেছে, অমুক প্রতিযোগিতায় আপনার ছেলে পুরস্কার পেয়েছে শুনলাম। তমুক অনুষ্ঠানে ওর বক্তব্য শুনেছি। আমার মা বাবার আনন্দ কিন্তু এখানেই।
পড়ালেখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর বাইরেও একটা বড় জগৎ আছে। মা–বাবাদের কাছে তাই অনুরোধ করব, আপনার সন্তানের জগৎটা বড় হতে দিন। ভাবনার জগৎ বড় হলেই তো সে বড় মনের মানুষ হবে।
আয়মান সাদিক টেন মিনিট স্কুলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা