আমরা কেমন আছি—এই প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে, আমরা ভালো আছি। অর্থনৈতিক দিক থেকে এই উত্তর খুব সত্য: আমাদের অর্থনীতি অনেক বড় হয়েছে। বিদেশিরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ একটা ইকোনমিক মিরাকল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বল গণতন্ত্র, সুশাসনের অভাব,
রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাপক দুর্নীতি ইত্যাদি অনেক গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে। সম্প্রতি তা আরও বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে: গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। এ ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় এক মালদ্বীপ বাদে আর সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছি। আমাদের দারিদ্র্য কমেছে; স্রেফ খেতে না পেয়ে কেউ মারা যায় না। আমরা ধান উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়েছি। মাছ–মাংস–সবজি–দুধ–ডিম ইত্যাদির উৎপাদন অনেক বেড়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পাকা রাস্তা হয়েছে। যন্ত্রচালিত ভ্যানগাড়ি, নছিমন–করিমন ইত্যাদি নানা ধরনের যানবাহন গ্রামাঞ্চলের মানুষের চলাফেরায় অবিশ্বাস্য রকমের গতি সঞ্চার করেছে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণচাঞ্চল্যে সজীব হয়ে উঠেছে সারা দেশ।
উন্নতি–অগ্রগতির এই তালিকা আরও অনেক লম্বা করা যায়। কিন্তু এই লেখায় তার প্রয়োজন নেই। আমরা কেমন আছি—এই প্রশ্নের সুখপ্রদ উত্তরের পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট। প্রশ্নটার দুঃখজনক উত্তরও যে আছে: আমরা ভালো নেই।
মানে? কী অর্থে বলা হচ্ছে যে আমরা ভালো নেই?
একটু বিমূর্ত অর্থে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির হাত ধরে আমাদের জীবনে সুখশান্তি বাড়েনি। এই দাবির পক্ষে গবেষণালব্ধ তথ্য–প্রমাণ আমার হাতে নেই। বরং পশ্চিমা দুনিয়ার কিছু গবেষকের সমীক্ষা বলে, বাংলাদেশ সুখী মানুষের দেশগুলোর তালিকায় ওপরের দিকে আছে। কিসের ভিত্তিতে তাঁরা এসব সমীক্ষা করেন, তা জানি না। কিন্তু আমি দেখতে পাই, কি গ্রাম কি শহর—সব অঞ্চলেই মানুষের মনে স্বাভাবিক স্বস্তিবোধের বেশ অভাব। যা পাওয়া হয়েছে, তাতে কেউই সন্তুষ্ট নয়। আরও পেতে চায়। আরও পাওয়ার পরেও চাওয়া ফুরায় না।
এ রকম মনোভাবের একটা কারণ সম্ভবত এই যে অতৃপ্তি মানুষের স্বভাবজাত; পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষই কমবেশি এ রকম। কিন্তু আমাদের দেশে আরও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়েছে বলে মনে হয়। এবং সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা সব সময় সোজা–স্বাভাবিক পথে চলে না। বাঁকা পথে, শর্টকাটে পেতে হবে। শর্টকাট পথগুলো প্রায়শ সৎ পথ হয় না; এ জন্য বলা হয় ‘দুই নম্বর’। আমাদের দুই নম্বরি অনেক বেড়েছে, সম্ভবত একটা জাতীয় চারিত্র্য অর্জন করেছে। আমাদের অবচেতন মন সম্ভবত সেটা জানে। তাই তার স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। তাই সে সব সময় অস্থির।
মানসিক অস্থিরতার একটা কারণ সম্ভবত এই যে ধনী–গরিব সব শ্রেণির মানুষের মনে সামগ্রিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ বেড়েছে। কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই—এমন বোধ সবার মনেই প্রবলতর হয়েছে। দোর্দণ্ড ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মফস্বলের ছোট ব্যবসায়ী, গ্রামের কৃষক, এমনকি নিরীহ সাধারণ গৃহিণী পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষের অনিশ্চয়তাবোধ ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ প্রবল। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় ভাবা হচ্ছে প্রধানত দুটো—অর্থসম্পদ ও ক্ষমতা। প্রত্যেকেই আরও টাকা চায়, প্রত্যেকেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। সে কারণেই টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাধরের কদর সবচেয়ে বেশি। সে কারণেই গ্রাম–মফস্বলের হাটে–বাজারে, পাড়া–মহল্লায় ঢুকে পড়েছে রাজনীতি। কেননা রাজনীতির সঙ্গে টাকাপয়সা ও ক্ষমতার সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়।
আর্থিক বা বৈষয়িক উন্নতির ফলে জীবন যে রকম স্বস্তিকর ও শান্তিময় হওয়ার কথা, আমাদের দেশে যে তা হয়নি, তার আরেকটা ইঙ্গিত পাই আন্তমানবিক সম্পর্কের অবস্থা দেখে। মানুষে–মানুষে সম্পর্ক আগের চেয়ে জটিল ও কূটিল হয়েছে। গ্রামে গেলে লোকজনের মুখে শুনতে পাই, কারও সঙ্গে কারও সদ্ভাব নেই। কেউ কারও মঙ্গল সইতে পারে না, বরং অন্যের অমঙ্গল দেখলেই খুশি হয়। সবচেয়ে বেশি শত্রুতা নিকট প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। কখনো কখনো তারা এমনকি পরস্পরের ক্ষতি করার প্রতিযোগিতায়ও মেতে ওঠে। প্রতিবেশীর পুকুরে বিষ ঢেলে দিয়ে শত্রুতা চরিতার্থ করার ঘটনার কথা শুনেছি একাধিক গ্রামে। এক বিঘাজুড়ে লাগানো কলাগাছের চারা রাতারাতি কেটে ফেলা, মিথ্যা মামলা দায়ের করে কিংবা থানা–পুলিশকে হাত করে প্রতিবেশী শত্রুকে নাজেহাল করার কথাও শুনেছি অনেক।
নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ—এই প্রবাদ যদিও বেশ প্রাচীন, তবু ধারণা করি, অতীতকালে এই মনোভঙ্গিটা পুরো জাতির সাধারণ মনোভঙ্গি ছিল না। এর জন্ম হয়েছিল মানুষের ব্যতিক্রমী আচরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিন্তু এখন এই মনোভঙ্গি বিরল বা ব্যতিক্রমী নয় বলে মনে হয়। শুধু গ্রামে নয়, মফস্বল শহরগুলোতেও মানুষে–মানুষে সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটেছে। এই অবনতির অত্যন্ত কদর্য ও নিষ্ঠুর প্রকাশ ঘটে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ভিন্ন ভিন্ন দলের মধ্যে তো বটেই, একই দলের ভেতরেও হিংসা–বিদ্বেষ প্রবল হয়েছে।
কোনো জনপদের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেউই ভালো থাকতে পারে না। কিন্তু অসূয়াপূর্ণ বা শত্রুমনোভাবাপন্ন মানুষেরা সেটা উপলব্ধি করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। বরং তারা মনে করে যে তারা ভালো আছে, এবং তাদের মনে হয়, অপরের অমঙ্গল কামনার মধ্যে সুখ আছে।
আমার এই দেখা যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন তোলা যায়, জাতিগোষ্ঠীগত বিভেদ থেকে মুক্ত, মোটের ওপর সমরূপ (হোমোজেনাস) এই দেশে সকলেরই যখন অভাব–অনটন কমেছে, আয়–রোজগার ও শিক্ষাদীক্ষা বেড়েছে, তখন কেন মানুষে মানুষে পারস্পরিক সদ্ভাব বাড়ল না? কেন সৌহার্দ্য–সম্প্রীতির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশটাকে আরও এগিয়ে নেওয়া, সুখী ও শান্তিময় জীবন গড়ার মনোভাব তৈরি হলো না? কেন তার পরিবর্তে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এমন জটিল, কুটিল, অসহিষ্ণু ও অসূয়াপূর্ণ হয়ে উঠল?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কীভাবে, কার কাছ থেকে পেতে পারি? আমার মনে উঁকি দিচ্ছে একটা সংশয়—মানবিক সম্পর্কের এই অবনতির সঙ্গে খুব দূর থেকে হলেও জনঘনত্বের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে কি না? সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ–মনস্তত্ত্ব গবেষকদের একটা অংশের বক্তব্য থেকে মনে হয়, সম্পর্ক আছে। মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও পারস্পরিক ব্যবহার জনঘনত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইঁদুরজাতীয় প্রাণীদের ওপর এ বিষয়ে বড় আকারে গবেষণা হয়েছে। তার ফল ভীষণ অপ্রীতিকর। অতিরিক্ত জনঘনত্ব ইঁদুর সমাজে এমন আচরণগত বিপর্যয় (বিহ্যাভিয়োর্যাল সিংক) ঘটায় যে তাতে তাদের ঝাড়ে–বংশে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইঁদুর সমাজের এই দৃষ্টান্ত মানুষের সমাজের জন্য খাটে না বলে বিজ্ঞানীদের একটা অংশ মনে করে। অন্য একটা অংশ মনে করে, হুবহু না খাটলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় খাটতে পারে।
ইঁদুর, শিম্পাজি বা এইপ গোত্রের অন্যান্য প্রাণীর ওপর যেভাবে গবেষণা চালানো সম্ভব হয়েছে, মানুষের ওপর সেভাবে সম্ভব হয়নি। ইউরোপ–আমেরিকায় সীমিত পরিসরে কিছু গবেষণা হয়েছে, বিশেষত কারাগার ও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের বাসিন্দাদের নিয়ে। মানুষের আচরণে জনঘনত্বের প্রভাব নিরূপণের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটো সূচক আমলে নেওয়া হয়—একটি অপরাধবৃত্তি, অন্যটি মানসিক অসুস্থতা। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে জনঘনত্ব বেশি হলেই অপরাধবৃত্তি ও মানসিক অসুস্থতা বাড়ে—এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা যায় না। নিউইয়র্ক সিটির সর্বাধিক জনঘনত্বপূর্ণ এলাকা ম্যানহাটানের বাসিন্দাদের মধ্যে দুটি সূচকই কম। জনঘনত্ব বেশি হলে মানুষের মধ্যে বিরক্তিবোধ (ইরিটেবিলিটি), বিচ্ছিন্নতাবোধ ও প্রতিযোগিতার মনোভাব বাড়ে এবং সহিষ্ণুতা ও সদ্ভাব কমে যায়। হাসপাতাল, ছাত্রাবাস, কারাগার ইত্যাদি স্থানে ভিড় বেশি হলে মানুষের পারস্পরিক ব্যবহারের অবনতি ঘটে। গবেষকেরা রাস্তাঘাট ও অন্যান্য জনসমাগমের জায়গার ভিড়ের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আর বাসস্থানের ভেতরে গাদাগাদি ভিড়ের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ করেছেন। বসবাসের জায়গায় জনঘনত্ব যত বাড়ে, মানুষের আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক ততই খারাপ হতে থাকে।
যেসব দেশে গবেষণা হয়েছে, তাদের জনঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। ম্যানহাটানের জনঘনত্ব এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৮ হাজার (১৯৭১ সালে অনেক কম ছিল), আর আমাদের ঢাকার জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৩৬ জন, আর বাংলাদেশে ১ হাজার ১২৫ জন। সামাজিক–রাজনৈতিক–প্রশাসনিক সংস্কৃতিসহ অনেক দিক থেকে ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের পার্থক্য বিরাট। তাদের দৃষ্টান্তগুলো আমাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি খাটে না। সাংস্কৃতিক পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা দৃষ্টান্ত: গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, সেসব দেশের খুব জনাকীর্ণ সমুদ্রসৈকতে নারী–পুরুষের অত্যধিক ভিড়ে মানুষের আচরণগত অবনতি ঘটে না। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশে জনাকীর্ণ বাজার (যেমন ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট), বিভিন্ন উপলক্ষে বিপুল জনসমাগমের স্থানগুলোতে (যেমন পয়লা বৈশাখে ঢাকার রমনা উদ্যান) পুরুষদের আচরণের অবনতি ঘটে, মেয়েদের নাজুকতা বাড়ে।
আমাদের অত্যধিক জনঘনত্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়েও ভাবার সময় হয়েছে। এ বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক