অভিবাদন বাংলাদেশ
অভিবাদন বাংলাদেশকে। স্যালুট বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। এই বাংলাদেশ হার না-মানা বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা ছায়াঢাকা পলিমাটির দেশের ছেলেগুলো আরব আমিরাতের রুখো মরুর বুকে অবতীর্ণ হয়েছিল এক কঠিন লড়াইয়ে। রোদ-তাতানো তন্দুরের মতো গনগনে মাঠে খেলা; একবার দুবাই, একবার আবুধাবিতে যাওয়া-আসার ভ্রমণজনিত ক্লান্তি—এবারের এশিয়া কাপে মাশরাফিদের প্রতিপক্ষ ছিল দৃশ্য-অদৃশ্য নানা কিছু।
আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ফর্মের তুঙ্গে থাকা তামিম ইকবাল আহত হলেন প্রথম খেলার প্রথম প্রহরেই। হাসপাতাল থেকে প্লাস্টার বাঁধা হাত নিয়ে ফিরে তামিম যখন দলের প্রয়োজনে মাঠে নামলেন ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান হয়ে, ব্যাট চালালেন এক হাতে—মাশরাফি ঠিকই বলেছেন, সে মুহূর্তেই তো চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে বাংলাদেশ। যে মুশফিক ১৪৪ আর ৯৯ রানের ইস্পাতদৃঢ় ইনিংস দিয়ে রচনা করেছেন আমাদের ফাইনালে যাওয়ার পথ, গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে যাঁর অপর নাম নির্ভরতা, তাঁরও যে পাঁজরে অসহ্য যন্ত্রণা, ব্যথানিরোধক ওষুধ খেয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি, এ কথা ভেবেও তো আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। পৃথিবীর ১ নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, ভাঙা আঙুল নিয়ে বল-ব্যাট-ফিল্ডিং করে যাচ্ছিলেন সংশপ্তকের মতো। ফাইনাল খেলার দিন তিনি ঢাকার হাসপাতালের বিছানায়, তাঁর হাতে অপারেশন হয়েছে, অনেক পুঁজ জমে গিয়েছিল ভেতরে-ভেতরে।
আর মাশরাফি বিন মুর্তজা! বারবার চিকিৎসকের ছুরির নিচে ফালি ফালি হয়েছে যাঁর হাঁটু, হাঁটুর নিচে কাপ বেঁধে যিনি খেলতে নামেন; পাকিস্তানের শোয়েব মালিকের ক্যাচটা যখন তিনি শূন্যে উড়ে লুফে নিয়েছিলেন, আমরা তো বহু কিলোমিটার দূরে টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম সর্বান্তঃকরণে। ফিল্ডিং করতে গিয়ে তাঁর আঙুল থেকে রক্ত ঝরছিল। কিপিং করতে করতে মুশফিক ব্যথায় শুয়ে পড়ছিলেন মাটিতে।
যোগ্য দল হিসেবেই বাংলাদেশ যে উঠে এসেছে এশিয়া কাপের ফাইনালে, শুক্রবারের চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিনে তার প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কাছে হেরে পাকিস্তান যখন ফিরে গেছে নিজ ডেরায়, শ্রীলঙ্কা দলে যখন শুরু হয়েছে পরাজয়োত্তর ঝড়, বাংলাদেশ তখন বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছে। দুদিনও তো বিরতি পাননি ছেলেরা। আবুধাবিতে পাকিস্তানের সঙ্গে স্নায়ুবিধ্বংসী অলিখিত ‘সেমিফাইনালের’ ধকল তো তখনো তাঁদের দেহমন থেকে মিলিয়ে যায়নি। ভারতের জন্য এই বিরামটা দিনের হিসাবে তিন দিন, কিন্তু ওদের পাঁচজন খেলোয়াড় যে আগের ম্যাচেও বিশ্রাম পেয়েছিল, সেটাও কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
কী দুর্দান্ত শুরুটাই না করেছিলেন লিটন দাস আর মেহেদী হাসান। স্বপ্নসম্ভব সেই আরম্ভটা অবশ্য ধরে রাখতে পারেননি ছেলেরা। ১২০ রানের উদ্বোধনী জুটির পর বাংলাদেশের ইনিংস শেষ ২২২ রানে। সে কি ফাইনালের চাপ, নাকি ক্লান্তি! হয়তো দুটোই। আর প্রতিপক্ষের নামও তো ভারত, যারা পাকিস্তানকে দু-দুবার এই আসরেই হারিয়েছে হেসেখেলে। ২২৩ তেমন কোনো লক্ষ্য নয়! ভারত কি তা-ই ভেবেছিল? আমরা, দূরবর্তী সমর্থকেরা কি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম?
কিন্তু এই দলের নামও বাংলাদেশ। এই সেই বাংলাদেশ, যারা জ্বলেপুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে সুসজ্জিত ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ লড়ে গেল। ২২২ রানের সামান্য পুঁজি নিয়ে তার এমনই ধনুর্ভঙ্গ পণ যে, দুর্দান্ত বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে কখনো স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি ভারতকে। ৫০ তম ওভারের শেষতম বলটি যখন হচ্ছিল, তখনো কেউ জানে না, এই ম্যাচের ভাগ্যে কী আছে! মাহমুদউল্লাহর করা ম্যাচের শেষ বলটিতে কেদার যাদব পড়িমরি করে একটা লেগ–বাই না নিতে পারলেও ম্যাচ টাই হয়, শিরোপার মীমাংসা হয় সুপারওভারে।
সবাই জানে, ভারতই এবারের এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন এবং অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। অভিনন্দন এশিয়া চ্যাম্পিয়ন ভারতকে।
কিন্তু কোটি কোটি ক্রিকেটামোদী দর্শকের কাছে চ্যাম্পিয়ন তো বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা। যেন এই বাংলাদেশ হেমিংওয়ের এই উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করতে নেমেছে—মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার পরাজয় নেই।
এই বাংলাদেশ অদম্য, অপরাজেয়, লড়াকু বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের পরাজয় নেই। অভিবাদন মাশরাফি এবং টিম বাংলাদেশ, তোমরা আমাদের বুক ভরে দিয়েছ; তোমরা আমাদের মাথা উঁচু করেছ। তোমরা আমাদের ভালোবাসা নাও।