একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর দেরি নেই। এ নিয়ে সাজ সাজ রব উঠেছে, রাজনৈতিক দল ছাপিয়ে নাগরিক সমাজেও তার উত্তাপ লেগেছে। পত্রপত্রিকায় এলাকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোও পিছিয়ে নেই—খবর এবং টক শোতে নির্বাচনের কথা আসছে ঘুরেফিরে।
বিএনপি এক যুগ ধরে সরকার ও সংসদের বাইরে। দলের নেত্রী কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দেশান্তরি, বহু নেতা-কর্মী কারাগারে কিংবা মামলা-মোকদ্দমায় ফেরারি। দলকে টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং অন্ততপক্ষে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সম্মানজনক অবস্থান ফিরে পাওয়া জরুরি। কিন্তু প্রধান দুই নেতাকে শাস্তি ভোগ করতে দিয়ে কীভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাও বড় চিন্তা। সরকার সুকৌশলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখতে চায়।
পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশসমূহ, জাতিসংঘ এবং ভারতের মতামত বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকার গঠনে কিছু প্রভাবক ভূমিকা পালন করে থাকে। বিএনপি তাদের পক্ষে আনার জন্য এবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। সরকারকে তারা বিব্রত করেনি। কেন করেনি, সেটা নিশ্চয় রাজনীতির মাঠে অবস্থানকারী বিএনপি নেতারা উপলব্ধি করেন।
বর্তমানে নির্বাচন সামনে রেখে পত্রপত্রিকায় ও আলোচনায় সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি উঠে আসছে। বিএনপি স্বভাবতই এ দাবিতে সোচ্চার, সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্য ও বামপন্থী দলগুলোও একই রকম দাবি তুলেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত—এ নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু এই কলরবের মধ্যে যেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা ভুলে না যাই। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনভিত্তিক সরকার গঠনের একটি প্রক্রিয়া নয়, যেমন শিক্ষা কেবল পরীক্ষাভিত্তিক ডিগ্রিপ্রাপ্তির কোনো পদ্ধতি নয়। এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। গণতন্ত্র নিছক কোনো পদ্ধতি নয়, এটি মূলত চেতনার বিষয়, রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন ও পরিচালনার দর্শন এবং এর কুশীলব অর্থাৎ প্রার্থী-ভোটার ও রাজনীতিবিদ সবার জন্য আবশ্যিকভাবে চর্চা শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিশেষ।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েই কেবল সংকট নেই, এ হলো রোগের লক্ষণ, মূল রোগ তো গণতন্ত্রের চেতনা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে। তার চর্চা ও লালন কি এ সমাজে হচ্ছে? হচ্ছে না বলেই নির্বাচন, রাজনীতি বা সরকারে এর আলামত প্রকাশ পায়। এ প্রেক্ষাপটে বলব গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের দায় এককভাবে আওয়ামী লীগের কাঁধেই চাপানো কি সংগত হচ্ছে? সমাজের চিন্তাশীল নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-তরুণ সবার ওপর কি পড়ে না এ দায়?
২০০১-২০০৬ শাসনামলে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে বিভিন্ন জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ সারা দেশে অনেক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, যার পেছনে এসব গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। কেবল তখন থেকে নয়, পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই এ দেশে আবার জামায়াত ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটে, তারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশ-বিদেশের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমরা দেখলাম সমাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গণতান্ত্রিক চেতনার অবক্ষয় ঘটছে, নানা অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে রাজনীতি আপস করে চলেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও এই আপসকামিতা আমরা লক্ষ করি। নির্দ্বিধায় বলা যাবে আওয়ামী লীগসহ সমাজের সর্বত্র উদারনৈতিকতার ক্ষয় ঘটছে ও রক্ষণশীলতার দাপট বাড়ছে। প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলব, বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের প্রতি সরকারের অনুদার কঠোরতা হয়তো এরই লক্ষণ। এমন সমাজবাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি মার খায় গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ। বাংলাদেশে তা–ই ঘটছে।
যাঁরা গণতন্ত্রের উদার সহিষ্ণু দর্শন ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে চান, তাঁদের চিন্তা কেবল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাওয়া দুঃখজনক। তাতে সরকারের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু সমাজের গণতন্ত্রায়ণের নিশ্চয়তা মেলে না। বরং এমন হতে পারে যে ২০০১-২০০৬ পর্বের মতো মনোভাব নিয়েই একটি সরকার গঠিত হতে পারে। সে সম্ভাবনা রদ করার মতো কোনো রক্ষাকবচ তাঁরা কি পেয়েছেন? অর্থাৎ বিএনপি কি ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও জঙ্গিবাদ পরিহারের বিষয়ে স্পষ্ট করেছে তাদের অবস্থান? বিএনপি কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়ে কৌশলগত নীরবতাই পালন করেছে, যেখানে খোদ জামায়াতের নেতাদের মধ্যে অবস্থান পরিষ্কার পরিমার্জন করার কিছু চিন্তাভাবনা শোনা গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা, ভাষা আন্দোলন ও তার চেতনা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বের অবস্থান ও বক্তব্য পরিষ্কার নয়।
সরকারে দুই মেয়াদে থাকার ফলে আওয়ামী লীগের দিকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আঙুল উঠবে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ ও দর্শনের শর্তও যে যুক্ত, সে কথা বেমালুম চেপে যাওয়া কি ঠিক হবে?
গণতন্ত্র অর্জন এবং তাকে শক্তিশালী ভিত দেওয়ার জন্য যেকোনো জাতিকেই সংগ্রাম করতে হয়। তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বটে, কিন্তু সেটি নিছক পদ্ধতির বিষয়, গণতন্ত্রের মূল সাবজেক্ট বা চর্চার বিষয় নয়। চর্চার বিষয় হলো বিভিন্ন মতাদর্শ, বিভিন্ন রাষ্ট্রদর্শন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, বিশ্ব পরিস্থিতি, যুক্তিবাদ ও মননশীলতা, মানবিকতা, উদারনৈতিকতা, ধর্ম ও নীতির দর্শন ও ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, এমনকি বিজ্ঞানবোধ ও তার ইতিহাস ইত্যাদি চর্চা ও গ্রহণ-বর্জনের মতো সহনশীল উদার পরিবেশ। তাহলেই একটি সমাজ চিন্তার জড়তা ও ভীরুতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ রচনার সাহস, প্রেরণা ও পথনির্দেশ পায়।
আমাদের সমাজে চিন্তাচর্চা ব্যাহত হচ্ছে। রাজনীতি যেমন, তেমনি শিক্ষা বা সমাজব্যবস্থায় কোথাও অবাধ চিন্তাচর্চার মুক্ত পরিবেশ নেই। এখানে আওয়ামী লীগ তো বটেই, বাম প্রগতিশীল দলের নেতৃত্বও বিপরীত চিন্তা–চেতনার সঙ্গে আপস করে চলে। এমনকি ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র পরিসরের গণতন্ত্রচর্চার নির্বাচনী প্রক্রিয়াও প্রথাপালন কিংবা ভানসর্বস্ব হয়ে পড়ছে, কোথাও সম্পূর্ণ থেমে গেছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন দশক ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না, হতে পারে না, ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাস দখলে রাখে। আমরা লক্ষ করছি চেম্বারগুলোতে নির্বাচন প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে, আপসেই নেতা নির্বাচিত হয়, ব্যবসায়ীদের অন্যান্য সংগঠনেও নির্বাচন পরিহারই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনে কোথাও সুবিধার, কোথাও টাকার আপস চলছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠেছে। সেটি আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে বলে নয়, এর মূল কারণ বরং অপর প্রধান দল মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করছে না। অতীত ঘাঁটলে মানুষ কি ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারবে? গণতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ে ভুল হলে বরং ২০০১ সালের পরিণতি বয়ে আনতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীসমূহ, ছাত্র-তরুণদের সংগঠন ও নানা সংস্থা কি গণতন্ত্রের চেতনা ও মূল্যবোধ চর্চায় এগিয়েছে?
এ অবস্থায় কেবল নির্বাচন থেকে গণতন্ত্রের ফল আশা করাকে দুরাশাই বলতে হবে। এটা ঠিক সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অধিকার ও ক্ষমতায়ন কোনো একক দলের স্বৈরশাসনে সম্ভব নয়। তার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রই প্রয়োজন। কিন্তু সেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য চাই মাঠে প্রধান দলগুলোসহ সিংহভাগ দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার। নয়তো আমরা গণতন্ত্রের শেষ ভরসা আওয়ামী লীগের মধ্যে উত্তরোত্তর স্বৈরাচারী প্রবণতা ও আপসকামিতার লক্ষণই প্রকট হতে দেখব। সেটা দেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় হবে।
আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক