অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, গৃহিণীদের অনেকের বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রে। যেকোনো কর্মদিবসে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কোনো অফিসে গেলে তা দেখা যায়। বিভিন্ন মেয়াদের সঞ্চয়পত্র ব্যাংকের শাখা বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কেনা ও ভাঙানো যায়। তবে, আমার নিজের অভিজ্ঞতা হলো বেশির ভাগ সময়ই ব্যাংকে নির্দিষ্ট সঞ্চয়পত্রটি থাকে না। কিন্তু সঞ্চয় অধিদপ্তরে তা সব সময় পাওয়া যায়।
মাস কয়েক আগে এ রকম একটি অফিসে গিয়ে দেখলাম, সেখানে কয়েকটি কম্পিউটার বসানো হয়েছে এবং নোটিশও লাগানো হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের বদৌলতে এখন থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজকর্ম হবে এবং ইচ্ছে করলে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক কেবল সোনালী ব্যাংকের হিসাবে নিজের মুনাফার টাকা পেতে পারবেন। সেদিন একটি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তোলা, সেটি নগদায়ন করে আরেকটি সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য আমার ‘মাত্র’ সাড়ে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। যদিও অফিসের কর্মীরা খুবই তৎপর ছিলেন আর বারবার বলছিলেন কম্পিউটার সিস্টেমটা নতুন বলে একটু সময় লাগছে। আগে এই কাজে সময় লাগত ঘণ্টাখানেক।
সম্প্রতি আবার সেখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো। কেন জানি না সেদিন সেখানে তেমন ভিড় ছিল না। আমরা গুটিকয়েক মানুষ। ভাবলাম, আজকে বুঝি তাড়াতাড়িই হবে। কম্পিউটারও আছে। কিছুক্ষণ পরেই আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আগে সঞ্চয় অধিদপ্তরে এক টেবিলেই সব কাজ হয়ে যেত। এখন আর সেটা হয় না। প্রথমে এক টেবিলে আগের সব কাজ করা হয় ম্যানুয়ালি।
আমি গিয়েছিলাম তিন মাস অন্তর সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে। প্রথমে আগের মতো আমাকে মূল সঞ্চয়পত্রসহ প্রযোজ্য কুপনগুলো স্বাক্ষর করে ওই টেবিলে লাইন ধরে জমা দিতে হয়েছে। বেশ কিছু কাগজ জমা হওয়ার পর সেখানকার একজন কর্মী প্রথমে স্বাক্ষরসহ কুপনগুলো সঞ্চয়পত্র থেকে আলাদা করে সঞ্চয়পত্রটি ফেরত দিলেন। তারপর একটি সাদা কাগজে নিবন্ধন নম্বর ও কিস্তির সংখ্যা লিখে নিলেন। প্রযোজ্য কুপনগুলো সেই কাগজে পিন করে নিলেন। এরপর এই তথ্যগুলো একটি বড় বালাম বইয়ে (রেজিস্ট্রার) হাতে লিখলেন। আমারটা লেখা হওয়ার পর আমি সেখানে স্বাক্ষর দিলাম। আগেকার নিয়ম ছিল এই সময়েই অধিদপ্তরের কর্মী টাকা দেওয়ার ব্যাংকের ভাউচারও তৈরি করে ফেলতেন। ব্যাংকের ভাউচারে নামধাম আমরাই লিখে দিতাম। তিনি টাকার অঙ্ক যাচাই করে সেটিতে স্বাক্ষর করে কর্মকর্তার স্বাক্ষরের জন্য পাঠাতেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর হয়ে সেটি সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে চলে যেত। ব্যাংকের প্রক্রিয়া শেষে টাকা হাতে পাওয়া যেত।
এখন আর ভাউচার এভাবে তৈরি হয় না।
অধিদপ্তরের কর্মী খাতায় পাঁচজন গ্রাহকের স্বাক্ষর নেওয়ার পর সাদা কাগজে পিনবদ্ধ কুপনগুলো নিয়ে তার পাশের আরেকটি টেবিলে বসলেন। ওখানেই কম্পিউটারটি রক্ষিত। তারপর তিনি খাতায় যেসব এন্ট্রি দিয়েছেন, তারই কয়েকটি কম্পিউটারে এন্ট্রি দেওয়ার পর প্রিন্টার থেকে ব্যাংকের ভাউচার প্রিন্ট হয়ে বের হয়ে এল। তারপর আমরা যথারীতি ভাউচারের পেছনেও স্বাক্ষর করলাম। সেটি কর্মকর্তার স্বাক্ষর হয়ে ব্যাংকে পৌঁছাল।
আমি ভাবলাম, কম্পিউটারে যেহেতু কাজ হয়েছে কাজেই ব্যাংকে হয়তো আর নতুন কোনো এন্ট্রি হবে না। কিন্তু দেখলাম ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আবার সেই ‘কাগজের ভাউচার’গুলো নিয়ে কী সব এন্ট্রি ও স্বাক্ষর করলেন। তারপর সেগুলো ক্যাশ কাউন্টারে দেওয়ার পর কাউন্টারে আরও দুটি স্বাক্ষর করে আমি আমার টাকা বুঝে পেলাম। আমি দেখলাম কম্পিউটারায়নের পর শুরুতে লেগেছিল চার ঘণ্টা আর এবার লাগল দুই ঘণ্টা। আমি কম্পিউটার সিস্টেমকে সেলাম দিয়ে অফিসে চলে গেলাম।
আমি জানি না, পৃথিবীর আর কোথাও এমনতর কম্পিউটারায়ন হয়েছে কি না। সরকারি দপ্তরে কম্পিউটারায়নের মূল লক্ষ্য সময় বাঁচানো, কাগজের ব্যবহার কমানো, পদ্ধতির দ্বৈততা কমানো, কাজের দক্ষতা বাড়ানো। অথচ সঞ্চয় অধিদপ্তরে আগে যে কাজ এক ঘণ্টায় করা যেত, এখন তা করতে দুই থেকে চার ঘণ্টা লাগে। সঞ্চয় অধিদপ্তরের যেকোনো অফিসে গেলে সেখানকার কর্মীদের তৎপরতা ও অমায়িক ব্যবহার আপনার চোখে পড়বে। তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চটুকু গ্রাহকদের দেওয়ার চেষ্টা করেন। কাঁটাবনের ছোট্ট অফিস কক্ষে জায়গা হয় না বলেই তাঁরা চেষ্টা করেন যেন গ্রাহককে কম সময় থাকতে হয়। কিন্তু কম্পিউটারায়নের পরও সেখানকার কর্মীদের নাভিশ্বাস কমছে না।
ই-গভর্ন্যান্সের বিশ্বব্যাপী উত্তম চর্চা হলো কম্পিউটারায়নের সময় পদ্ধতির পুনঃ প্রকৌশল করা (প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং)। বলা হয়ে থাকে, একটি সফল ই-গভর্ন্যান্স প্রজেক্টের ৪০ শতাংশই হলো সরকারি পদ্ধতির পুনঃ প্রকৌশল আর মাত্র ১৫ শতাংশ হলো প্রযুক্তি। এর অনেক সফল উদাহরণ আমাদের দেশেই পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস অটোমেশনের সময় টেবিলে টেবিলে ৪২টি স্বাক্ষরকে মাত্র ৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোবাইল ফোনে ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করাতে এখন আর ভর্তি ফরম ছাপাতে হয় না, ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের একবার কাগজের ফরম সংগ্রহ ও তারপর পূরণকৃত ফরম জমা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সশরীরে যেতে হয় না। এমনকি ভর্তি ফিও মোবাইলে দেওয়া যায়। আর এসবই হয়েছে প্রায় এক দশক আগে।
অথচ এই ২০১৮ সালে ম্যানুয়াল পদ্ধতি বহাল রেখে কাগজের ব্যবহার বাড়িয়ে কেউ কোনো কম্পিউটার সিস্টেম ডিজাইন করতে পারে, তা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে না গেলে আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। যে স্বাক্ষর করা কুপনই একজন গ্রাহককে টাকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, তাঁর সময়, শ্রম নষ্ট করে অহেতুক একাধিক স্বাক্ষর গ্রহণের মাজেজাবোঝা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কুপন, বালাম বই, ভাউচারের পেছনে আমার মাত্র তিনটা স্বাক্ষর দিতে হয়েছে। ভাববেন না, যাঁরা নগদ টাকার পরিবর্তে ব্যাংক হিসাবে টাকা নেন, তাঁদের এই কাজগুলো করতে হয় না। তাঁদের জন্যও ওই একই ভাউচার তৈরি হয়, স্বাক্ষর করতে হয় এবং ব্যাংকে গিয়ে ওই ভাউচার ঠিক ঠিক ব্যক্তির কাছে গেল কি না, সেটির খোঁজ রাখতে হয়!
অথচ কম্পিউটারায়নের ফলে অধিদপ্তরে একটি সঞ্চয়পত্র গ্রহণের কাউন্টার করেই সব কাজ করে ফেলা যেত। গ্রাহক কেবল তাঁর নিবন্ধন নম্বর ও স্বাক্ষর করা কুপন সেখানে জমা দেবেন। বাকি সব কাজ কম্পিউটারে হয়ে সেটি ব্যাংকের কম্পিউটারকে আপডেট করে দেবে। যাঁরা ব্যাংক হিসাবে (শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, যেকোনো ব্যাংকের যেকোনো শাখায়) টাকা নেবেন তাঁদের আর ব্যাংকেই যেতে হবে না, অধিদপ্তর থেকে বাড়ি চলে যাবেন। আর যাঁরা নগদ নেবেন তাঁরা ব্যাংকে গেলেই টাকা পেয়ে যাবেন। আর কোনো সই-স্বাক্ষরও লাগবে না। শুধু তা–ই নয়, পর্যায়ক্রমে এই কুপন সিস্টেমও তুলে দেওয়া যাবে। সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের মুনাফার টাকা নির্ধারিত সময়ের পর পর তাঁর ব্যাংক হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে, যেমনটা যায় আপনার শেয়ারের ডিভিডেন্ডের টাকা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ও অটোমেশনে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষক সচিবালয়ের ই-ফাইলিং কার্যক্রমের কথা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, সচিবালয়ে ই-ফাইল পদ্ধতি হওয়ার কারণে একটা চিঠি জায়গামতো পৌঁছাতেই আগের চেয়ে এখন ঢের বেশি সময় লাগে। কয়েকবার ফোনে তাগাদা দেওয়াতে তাঁকে বলা হয়েছে, ‘আপনি এর কী বুঝবেন? কম্পিউটারের মাধ্যমে ফাইল পাঠানো অনেক জটিল প্রক্রিয়া।’
মুনির হাসান : গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক