ইভিএম সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়াবে

বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছে। নির্বাচন কমিশন তড়িঘড়ি করে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে, কিন্তু অনেক রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে। ইভিএম চালুর পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা বলা হচ্ছে। যেমন নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, সারা পৃথিবীতে ইভিএম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কথা সঠিক নয়। আবার ইভিএম কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে না-এ কথাও ঠিক নয়।

গত ১০ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে। বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য। সম্প্রতি ভারতেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে এককাট্টা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী আমাদের নির্বাচন কমিশন যে ইভিএম ব্যবহার করতে চায়, তা সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের সমন্বয়ে গঠিত। হার্ডওয়্যার দুটি ইউনিটে বিভক্ত: ব্যালট ও কন্ট্রোল ইউনিট। ব্যালট ইউনিটে প্রার্থীদের নাম ও মার্কাসংবলিত ছবি এবং সুইচ থাকবে। কন্ট্রোল ইউনিটে চারটি অংশ থাকতে পারে-প্রসেসর, স্মৃতি, ডিসপ্লে ও ব্যাটারি। ভোটার তাঁর পছন্দের মার্কাসংশ্লিষ্ট সুইচে চাপ দেবেন এবং কন্ট্রোল ইউনিট প্রার্থী অনুযায়ী ভোট প্রসেস করে ভোটের হিসাব রাখবে। ভোট শেষে প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতিতে কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ভোটের ফলাফল জানা যাবে।

এখানে একটা সমস্যা আছে। ধরা যাক, একটি নির্বাচনে চারজন প্রার্থী-ক, খ, গ ও ঘ। ভোটার সংশ্লিষ্ট বাটনে চাপ দেবেন। একটি আদর্শ অবস্থায় কন্ট্রোল ইউনিটের প্রসেসর ব্যালট ইউনিট থেকে প্রেরিত সংকেত অর্থাৎ চারজন প্রার্থীর ভোট আলাদা আলাদভাবে স্মৃতিতে ধরে রাখবে। চারজন প্রার্থীর ভোট আলাদা আলাদাভাবে প্রসেস করে তা স্মৃতিতে প্রেরণের জন্য কন্ট্রোল ইউনিটের মাইক্রো চিপকে প্রোগ্রাম করা হবে। মূল সমস্যাটা এখানেই। এই মাইক্রো চিপকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব যে একজন ভোটার ক, খ কিংবা গ যাকেই ভোট দিক না কেন, তা ক প্রার্থীর ভান্ডারে জমা পড়বে। মোটামুটিভাবে দক্ষ একজন প্রোগ্রামারের জন্য এটা করা খুব সহজ। আবার এমনও করা সম্ভব যে বিশেষ কিছুসংখ্যক ভোটের হিসাব ঠিকমতো রেখে পরে চিপ তার আচরণ বদলে ফেলবে। পুরোটা নির্ধারণ করছে সফটওয়্যারের সোর্স কোডের ওপর।

ব্যালটের মাধ্যমে যখন ভোট গ্রহণ করা হয়, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যালট বাক্সটিকে প্রার্থীদের এজেন্টদের উন্মুক্ত করে দেখান। ইলেকট্রনিক মেশিনের ক্ষেত্রে তিনি আসলে কী দেখাবেন? ভোটিং মেশিনের কন্ট্রোল ইউনিটের চিপ কীভাবে প্রোগ্রাম করা আছে, সেটা দেখাবেন কি? সেটা দেখাতে পারলেও আদৌ বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখাতে পারবেন কি? এই সফটওয়্যারের সোর্স কোড দেখাবেন কি? দেখালেও তা বুঝবে কে? একটি ইভিএমের সার্কিট বোর্ডের স্থাপত্যও দেখা জরুরি। কন্ট্রোল ইউনিটের সার্কিট বোর্ডে একটি ইনফ্রারেড রিসিভার সার্কিট এমনভাবে জুড়ে দেওয়া সম্ভব যে বাইরে থেকে মোবাইল ফোনের ব্লু-টুথ সংযোগের মাধ্যমে ভোটের সর্বশেষ অবস্থা জানা যাবে এবং তা পরিবর্তনও করা যাবে।

২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচন কমিশন ইভিএম সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় জানিয়েছে: প্রতিটি ইভিএম স্বতন্ত্র এবং কেউ একসঙ্গে এগুলোতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার পরিবর্তন করতে পারবে না; এই ইভিএমগুলোর কোনো কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না; ইভিএমগুলোতে সফটওয়্যার ইনস্টল করার সময় সব রাজনৈতিক দলের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমরা একমত। কেউ একসঙ্গে সবগুলো ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যার পরিবর্তন করতে পারবে না। তবে সেটা করার দরকারও নেই। বাংলাদেশের শতকরা ১০ ভাগ ইভিএমকে টেম্পার করলেই নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব। আর যেহেতু ইভিএমগুলো স্বতন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না, সেহেতু ইভিএম শুধু ভোট গণনার সময় কমিয়ে আনবে। সার্বিকভাবে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার সময় কমিয়ে আনবে না।

ইভিএমের আরেকটি কারিগরি অসুবিধা হলো এই যে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে একজন ভোটার তাঁর পছন্দমতো বাটন ঠিকই পুশ করবেন কিন্তু তিনি দেখতে পারবেন না ভোটটা তাঁর পছন্দের প্রার্থী পেলেন কি না। জার্মানির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়োকিম ভিসনা এবং তাঁর পুত্র উলরিখ ভিসনা এই অস্বচ্ছতার কারণেই জার্মানির সাংবিধানিক আদালতে ইভিএম বাতিলের আবেদন করেন। ২০০৯ সালের ৩ মার্চ আদালত নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। সাংবিধানিক আদালতের বিচারক বলেন, ইভিএম অস্বচ্ছ এবং ইভিএম দিয়ে কীভাবে ভোট গ্রহণ ও গণনা করা হয়, তা একজন সাধারণ ভোটারের বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া, ইভিএমে ভোট দেওয়ার পরে স্পর্শ করার মতো কোনো দালিলিক প্রমাণ থাকে না। তাই পরবর্তীকালে ফলাফল নিরীক্ষণ করার কোনো সুযোগ নেই। ইভিএমের সফটওয়্যার কিংবা হার্ডওয়্যার ভোটে কোনো প্রতারণা কিংবা ভুল করছে কি না, তা পরবর্তীকালে যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টা দপ্তরের হিসাবের গন্ডগোল দূর করার জন্য হিসাবরক্ষণ বিভাগকে অবলোপন করার মতোই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ কাউন্টিতে ভোটাররা ভোট দেন ব্যালট পেপারে, সে ব্যালট পেপার ইলেকট্রনিক কাউন্টিং মেশিন দিয়ে গণনা করা হয়। এতে একটি সুবিধা হলো, যেহেতু ব্যালট পেপারের অস্তিত্ব আছে, সেহেতু গণনায় ভুল হলে নতুন করে গণনা করা যায়। আমাদের আলোচিত পদ্ধতিটিকে বলা হয় ডিআরই (ডিরেক্টলি রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক) সিস্টেম। পদ্ধতিগতভাবেই এটি কম নিরাপদ। একজন শিক্ষানবিশ প্রোগ্রামারও এর জন্য এমনভাবে কোড লিখতে পারবেন, যাতে একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর ডিসপ্লেতে দেখা যাবে একরকম, মেমোরি মডিউলে লেখা হবে আরেক রকম এবং ফলাফল তৈরি করবে আরেক রকমভাবে। ঝুঁকিটা অনেক বেশি, সে তুলনায় প্রাপ্তিটা হবে অতি নগণ্য। যেহেতু পেপার ট্রেইল নেই, কারচুপির অভিযোগ উঠলে তা প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব। নেদারল্যান্ডস ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করেছে কারচুপির কারণে নয়, বরং এই মেশিন টেম্পারিং করা যাবে না-এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বলে।

নির্বাচন কমিশন বলেছে, ইভিএম নির্বাচনী ব্যয় কমিয়ে আনবে। কীভাবে কমিয়ে আনবে, কতটুকু কমিয়ে আনবে-সে সংশ্লিষ্ট সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের জানা নেই। আমরা এ-ও শুনেছি যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পরিবেশবান্ধব। একটি নির্বাচন কতটুকু পরিবেশবান্ধব, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন কতটুকু স্বচ্ছ। নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ব্যয়সংকোচন কিংবা পরিবেশ রক্ষা নয়-জনগণের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশকে নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা। আর যাঁরা মনে করেন, ইভিএম খুব অল্প সময়ে নির্বাচনের ফলাফল দিতে পারে, তাঁদের জেনে রাখা ভালো-জাতীয় নির্বাচনের দ্রুত ফলাফল আমাদের কখনোই কোনো জোরালো দাবির মধ্যে ছিল না। ইভিএম জাল ভোট দেওয়া বন্ধ করতে পারবে না এবং জোর করে ভোট দেওয়াও বন্ধ করতে পারবে না। ভোটকেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই আমাদের দেশে সাধারণ ঘটনা। একটি কেন্দ্র থেকে এক-দুটি ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলে শুধু ছিনতাই হয়ে যাওয়া বাক্সের ভোট গণনায় আসবে না। কিন্তু যদি ইভিএমই ছিনতাই হয়ে যায়?

নির্বাচন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ চরমে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এ রকম একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার সন্দেহ-অবিশ্বাস আরও বাড়াবে, নির্বাচন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

কাজী মাহফুজুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক