ক্ষমা চাইছি আঠারোর কাছে

বেশ কিছুদিন আগে লেখক–শিক্ষাবিদ হায়াৎ মামুদের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোতে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন বর্তমানে ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধের কথা। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হায়াৎ মামুদ বলেছিলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছু ঘটবে না।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মা-বাবাদের প্রতি তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা যেন ছেলেমেয়েদের প্রতি লক্ষ রাখেন আর চলতে বলেছিলেন সেভাবে, যেভাবে চললে আগামী প্রজন্ম পরার্থপর হয়। শুধু নিজের নয়, সবার কথা ভাবে।’

আমি খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম তাঁর সাক্ষাত্কারটি। আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার প্রতিফলন পেয়েছিলাম সেদিন তাঁর এই সাক্ষাত্কারে। তবে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন কলেজ শিক্ষার্থীর প্রাণ হারানোর সূত্র ধরে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে কেবলই মনে হচ্ছে কোথায় যেন হিসাবে বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে আমাদের । আমরা কখনো উপলব্ধি করিনি উদীয়মান প্রজন্মের দৃঢ়তা, ন্যায়নিষ্ঠা আর আত্মপ্রত্যয়ের বিষয়টি। আমরা বুঝিনি, তারা হার না মানা, সত্যের প্রতি অবিচল আর পাহাড়ের মতো অটল। ভেবে দেখিনি রাত-দিন মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে থাকা একটি প্রজন্ম অন্যায়ের প্রতিকারে সব তুচ্ছ করে প্রয়োজনে গর্জেও উঠতে পারে। আমরা তোমাদের সক্ষমতার প্রতি উদাসীন ছিলাম, অন্ধ ছিলাম। তাই তোমাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারার অপরাধে অপরাধী। আজ তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো শিক্ষাজীবনে সাক্ষী হয়েছিলাম বেশ কিছু ঘটনার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, শামসুন নাহার হলে মধ্যরাতে পুলিশি নির্যাতন ইত্যাদি। ঘটনার প্রতিবাদে সেসব আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় অকার্যকর করে ফেলেছিল। শামসুন নাহার হলের ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে গড়ে তোলা আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত পতন ঘটেছিল তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরীর। মনে পড়ে নিয়ম অমান্য করে ছুটে আসা এক বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল শামীমা আক্তার (হ্যাপি) নামের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। সে ঘটনার রেশ ধরে বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সে আন্দোলনকে আমরা তোমাদের মতো বেগবান করতে পারিনি। সে আন্দোলনে আমরা সম্পৃক্ত করতে পারিনি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে। মানুষের বিবেককে আমরা তোমাদের মতো করে নাড়া দিতে পারিনি। আমরা তোমাদের মতো অনমনীয় অবস্থান নিতে পারিনি। এমনকি আমরা সেভাবে রুখে দাঁড়াইনি তারেক মাসুদ কিংবা মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পরও। সেদিন আমরা যদি তোমাদের মতো অনড় অবস্থান নিতাম, তাহলে হয়তো আজকে তোমাদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামতে হতো না। আর অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মৃত্যুর তালিকাটাও হয়তো এতটা লম্বা হতো না।

এত দিন আমরা শুধু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে চলেছি, তোমরা কী করো না, কী জানো না, কী পারো না, কী শিখতে চাও না ইত্যাদি নিয়ে। এই নেতিবাচক বিশ্লেষণের আড়ালে ঠিকমতো করা হয়ে ওঠেনি তোমাদের ইতিবাচক দিকগুলোর বিশ্লেষণ। বুঝতে পারিনি তোমাদের শিক্ষার আর তোমাদের জ্ঞানের পরিধির স্কোরকার্ড নিয়ে বসে থাকা এই বড়রাই আসলে এক-একটি কূপমণ্ডূক, নিরেট মূর্খ। আমরা বড়রা যেমন সব সময় চোখে আঙুল দিয়ে তোমাদের শেখাতে আসি, তোমরা কিন্তু তেমনটি করোনি মোটেই। বরং সুনিপুণভাবে তোমরা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিবেকের কাঠগড়ায়। প্রশ্ন করেছ আমাদের আদর্শ, সততা আর মূল্যবোধ নিয়ে। প্রশ্ন করেছ রোজ অন্যায় করা আর অন্যায় সয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর অনুভূতির কাছে। প্রতিবাদের মার্জিত ভাষা যে এতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা কি এই দেশে আগে কেউ জানত! প্রতিবাদের এই অনন্য ভাষা তোমরা কোথায় শিখলে? বইয়ের পাতায় তোমাদের যা শিখিয়েছি, তা আমরা নিজেরা বাস্তব জীবনে করে দেখাইনি। তাই আদৌ তোমাদের শিক্ষা দেওয়ার কোনো যোগ্যতা কি আমাদের আছে?

শৈশবে আমরা পড়েছি, ‘অ তে অজগর ওই আসছে তেড়ে।’ এ যুগের শিক্ষাবিদেরা বলেন, শিশুদের অজগরের ভয়ে ভীত না করাই ভালো। ভয় নাকি শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। তাই অজগরের পরিবর্তে অজ অর্থাৎ ছাগলকে বইয়ের পাতায় নিরাপদে আমরা গাছেও তুলেছি। আর ওদিকে বেপরোয়া গতির বাস-মিনিবাসসহ হাজারো রকম আতঙ্ক, যৌন হয়রানি আর প্রতারণার মরণফাঁদ যে প্রতি মুহূর্তে অজগরের চেয়ে হাজার গুণে শক্তিশালী হয়ে আমাদের সন্তানদের তাড়া করে ফিরছে, তা কি শিক্ষাবিদসহ দেশের নীতিনির্ধারকেরা কখনো ভেবে দেখেছেন!

তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশকে শাসকগোষ্ঠী বাহবা দেয়। আমরা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করি, চাঁদে পা রাখার স্বপ্নের কথা বলি জোর গলায় আর ওদিকে বাস্তবায়নযোগ্য হাজার হাজার স্বপ্ন রয়ে যায় অধরা। এত সব বৈসাদৃশ্য তরুণ রক্ত মানবে কেন? তাই আমাদের মরচে পড়া, হার মানা অস্তিত্বের কোনো যোগ্যতা নেই তরুণ রক্তকে নতুন কিছু শেখানোর। আমরা পরাজিত, লজ্জিত ও ধিক্কৃত। আমরা বড়রা শুধু জানি কীভাবে তোমাদের নিখাদ সত্যের সংগ্রামে ভেজাল মেশাতে হয়। তোমাদের শেখানোর সব যোগ্যতা আমরা হারিয়েছি। তাই তোমরাই আমাদের নেতৃত্ব দাও, আমাদের পথ দেখাও।

নিশাত সুলতানা, লেখক ও গবেষক
[email protected]