দিয়া আর রিয়া দুই বোন। এক ফ্রেমে দুজনের ছবি পড়ার টেবিলে। দিয়া কলেজের প্রথম বর্ষে। রিয়া পড়ে দ্বিতীয় বর্ষে। দিয়া শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। রিয়া পড়ে মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলেজে। রিয়া বড়, দিয়া বছর দেড়েকের ছোট। এক বিছানায় ঘুমায়। এক টেবিলে পড়তে বসে।
ওরা এক স্কুলেই পড়ত। কলেজে উঠে আলাদা হয়ে গেল শিক্ষায়তন। রিয়া হতে চায় ডাক্তার। দিয়া কী হতে চাইত?
দিয়ার কথা বলতে হচ্ছে অতীত কাল ব্যবহার করে। রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। রিয়া ডুকরে কেঁদে উঠল। মাথা নিচু করল। দুহাতে মুখ ঢাকল। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ও ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিল।
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশের দিকে তাকাতে পারি না। অফিসে এসেছি। প্রগতি ভবনে আমাদের নতুন কার্যালয়ে কাচের দেয়াল দুদিকে। আমার টেবিল থেকে আকাশ দেখা যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ভিজে আসে। এই মেঘ-বৃষ্টি আমি সইতে পারছি না। মেঘ সরিয়ে একটু আলো আসছে। আমার অপরাধী লাগে নিজেকে।
১৭ ও ১৮ বছরের কিশোর-কিশোরীরা কলেজ ছুটির পর বাড়ি ফিরবে বলে বেরিয়েছিল। নিজেদের ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে বাসের জন্য পথের একদম কিনার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা। হয়তো তারাও খুশিতে বলে উঠেছিল, ছুটি ছুটি, গরম গরম রুটি।
ওই কিশোর-কিশোরীগুলোর ওপর দিয়ে বাস চলে গেল! দুটো বাস পাল্লা দিল! আমাদের এই শহরটাকে আমরা শিশু হত্যা, কিশোর হত্যার জন্য বধ্যভূমি বানিয়ে রেখেছি! একেকটা বাস চলছে, যেন সেসব যানবাহন নয়, খুন করবার লাইসেন্সধারী একেকটা মারণযন্ত্র। যন্ত্রদানব। ধাবন্ত ঘাতক!
‘কিশোর আলো’র রঙিন প্রচ্ছদ আমাকে বিদ্রূপ করে! সব ছাপিয়ে আমার মনে ভাসে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের হাসি। আমার মনে একেবারেই সাদাসিধে প্রশ্ন জাগে, কোনো মৃতের স্বজনকে গিয়ে আমি কখনো বলতে পারব, আপনি কেন বিলাপ করছেন, আপনার তো একজন স্বজন মারা গেছে, গত বছর অমুকের যে দুজন মারা গিয়েছিল, ও তো এত চিৎকার করে কাঁদেনি। এটা বলা যায়?
ভালো লাগে না কিছু। আমি বেরিয়ে পড়ি অফিস থেকে। সঙ্গে নিই আলোকচিত্রী হাসান রাজাকে। জানি, রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ হচ্ছে। আজ না বেরোনোই ভালো।
কিন্তু আমি যাবই। আমাকে যেতেই হবে। প্রথমে ভেবেছিলাম, হাসান রাজার বাইকে উঠে পড়ব। কিন্তু এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো।
গাড়িই নিতে হলো। ঠিক ১২টায় গাড়ি ছাড়ল কারওয়ান বাজার থেকে। তেজগাঁর সামনে পৌঁছাতেই বেজে গেল বেলা দুটো। গুলশান ১ থেকে ২ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই বেজে গেল বিকেল সোয়া চারটা। কোনো কিছুই নড়ছে না। স্থবির হয়ে বসে থাকা। পাক্কা সোয়া চার ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার পাড়ি দিলাম।
এর মধ্যে ফেসবুকে পড়ছি বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া।
সাংবাদিক আরিফ জেবতিক লিখেছেন, ‘বাচ্চা দুটো স্কুলগেটে আটকে আছে...। খুব জরুরি মিটিং ছিল আমার, সেটা মিস হয়েছে-আমিও আটকে আছি আরেক জায়গায়।...তবু এই নগর অচল করে দেওয়ার জন্য আমি শিক্ষার্থীদের অভিবাদন জানাই। যে শহরের সরদার একদল মাফিয়া পরিবহন নেতা, তাদের বিরুদ্ধে এই প্রজন্মের এই বিক্ষোভে আমার অকুণ্ঠ সমর্থন।’
একই রকমের বক্তব্য আরও আরও ভেসে আসছে টাইমলাইনে।
গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গেলাম খানিকটা। তারপর একটা রিকশায় গুলশান মসজিদ, আরেক রিকশায় বনানী গোরস্থান। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম র্যাডিসনের উল্টো দিকে।
শহীদ রমিজউদ্দীন কলেজের গেট ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। গেটে কালো ব্যানারে শোকবাণী ঝুলছে তাদের দুই শিক্ষার্থীর তিরোধানে। কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে, যেখানে মিরপুর থেকে আসা উড়ালসেতুটা নেমে গেছে, সেখানে এখনো একজোড়া স্যান্ডেল পড়ে আছে। মেয়েদের স্যান্ডেল। একদল শিক্ষার্থী ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছে, নীরব প্রতিবাদে। আরেক দল শিক্ষার্থী ছুটে এল আমাকে দেখে, ‘স্যার, ওই যে কালো স্যান্ডেলটা দেখছেন, ওটা সজীবের স্যান্ডেল। এই যে সজীবের ছবি।’ সে তার মোবাইলে তার সহপাঠী সজীবকে দেখাল। সামরিক হাসপাতালের বিছানায় আহত সজীব। তাদের বেশ কজন বন্ধু সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন, জানাল রবিউল আর বিজয় প্রধান নামের দুজন শিক্ষার্থী, ‘ওরা ভালো আছে, স্যার। কথা বলে এলাম। একজন আইসিইউতে।’
আর ওদের দুই বন্ধু দিয়া আর আবদুল করিম আর এই পৃথিবীতে নেই। রাস্তার ধারের দেয়ালে এখনো বাসের আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। একটা গাছ পর্যন্ত উপড়ে পড়ে আছে বাসের ধাক্কায়। তারই কাছে মাঝরাস্তায় পড়ে আছে সজীবের স্যান্ডেল। কতটা বেপরোয়া বা নিয়ন্ত্রণহারা হলে বাস গিয়ে ধাক্কা দিতে পারে পাশের প্রাচীরে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪৯)। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার মানুষ তিনি। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি গাড়ির সঙ্গে, ২৭ বছর ধরে বাস চালান। এখন বাস চালান ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে। মহাখালীর দক্ষিণপাড়ার মসজিদ গলির ভেতরে তার বাসা। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ গেছে ফুলে। আমরা সেই বাসায় যখন পৌঁছাই, ৩০ জুলাইয়ের দিনের আলো তখন নিভে এসেছে। দিয়ার মা, দিয়ার বোন রিয়া, ছোট ভাই রিয়াদ তখন কবরস্থানে গেছে দিয়ার কবর দেখতে। গত রাতেই তারা দাফন-কাফন সম্পন্ন করেছে, নিকটবর্তী কবরস্থানে শুইয়ে এসেছে তাদের প্রিয় মানুষটিকে!
জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ‘আমার জীবনে আমি কোনো দিন কাউকে মারিনি। হাসপাতাল বাজার স্কুলের সামনে সাবধানে চালাই, হর্ন বাজাই না।
‘শোনেন, আমি তো মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে নির্বাচনও করেছিলাম, নির্বাচিতও হয়েছিলাম। অ্যাকসিডেন্ট তো হতেই পারে। কিন্তু এটা তো অ্যাকসিডেন্ট না। এটা হলো ইচ্ছাকৃত খুন। একটা বাস দাঁড়িয়েছে, বাচ্চারা সেটাতে ওঠার জন্য গেটের কাছে গেছে, আরেকটা তারও বামে চলে গেছে বাহাস করে, ডানেরটা তখন তাকে বামে চাপ দিয়েছে। এর মধ্যেই আমার মেয়েটা...ফেসবুকে ছবি আছে, একজন দয়াবান মানুষ তাকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমার কাছে ফোন এল। আমি গেলাম হাসপাতালে। বলল, “আপনি দিয়ার বাবা? এই ঘরে আসেন। ” ওই ঘরে আমার মেয়ে শুয়ে আছে...আমি তো বুঝতে পারলাম আমার মেয়ে আর নাই। জীবনে আমি কারও ক্ষতি করলাম না, আর আমার কপালেই এটা হলো...।’
তিনি চোখ মোছেন। আমি চোখের জল লুকোই কোথায়?
ততক্ষণে রিয়া, রিয়াদ আর ওদের মা এসেছেন। মা শুধু কাঁদেন। ওর খালা বললেন, মন্ত্রী এটা কী বলল? মন্ত্রী হাসে কেন!
দিয়া আর রিয়ার পড়ার ঘরে যাই। খুব ছোট একটা কামরা। রিয়ার কলেজের ব্যাগটা আছে। দিয়ারটা আর ফিরে আসেনি। ওদের পড়ার টেবিলে দুজনের একটা ছবি নকশাকাটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা। রিয়া শুধু কাঁদে। দুই বোন। পিঠাপিঠি। একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে ঘুমায়, একসঙ্গে পড়াশোনা করে। কলেজটা আলাদা হলো। এখন এই সন্ধ্যায় ছোট বোনটা কবরে মাটিতে একলা শুয়ে রইল!
রিয়াদ কোনো কথা বলে না।
আত্মীয়স্বজন এসেছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেন, সারাটা দিনে কোনো নেতা খোঁজ নিতে আসেননি, কোনো মন্ত্রী না। শুধু সাংবাদিকেরা এসেছেন।
লাইলি নামে দিয়ার খালা বলেন, ‘আপনারা মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি ভারতের সঙ্গে তুলনা দিলেন কেন?’
জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ‘এটা তো দুর্ঘটনা না, এটা ইচ্ছাকৃত খুন। আমি নিজে ড্রাইভার, কিন্তু এই দোষী ড্রাইভারের ফাঁসি চাই।’
ইচ্ছা ছিল শাজাহান খানের সামনে যাব। তাঁকে জিজ্ঞেস করব, তিনি কেন এমনটা বললেন। অনলাইনে পড়লাম, তিনি বলেছেন, ‘আমার অভ্যাস, সব সময় আমি হাসি। হাসা কি খারাপ?’
মন্ত্রীকে পেলাম মুঠোফোনে। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, দিয়ার বাবা নিজে ড্রাইভার হয়ে বলছেন, এই অপরাধে দোষী চালকের ফাঁসি চান তিনি। আপনি কী বলেন? আপনার কথা নিয়ে তো ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভের ঝড় বইছে। আপনি কি অবস্থান বদলাবেন?
তিনি বললেন, ‘আজকে তো আমি সারা দিনে অনেক গণমাধ্যমকে বলেছি, সঠিক তদন্ত হোক, দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’
আমি বললাম, ফাঁসি কথাটা আপনি বলবেন কি না।
তিনি বললেন, ‘আমার বক্তব্য, আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা হোক।’
আপনি পরিবহনশ্রমিকদের নেতা। আপনার কাছে তো চালকদের পরিসংখ্যান আছে, হিসাব আছে। সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে আপনারা কিছু করেন না কেন?
তিনি বললেন, ‘অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছিল, তারা অনেক দফা সুপারিশ করেছে। বহু কিছু করণীয় আছে। শোনেন, আমাকে পরিবহনশ্রমিকেরা মান্য করে। পেট্রল-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই শ্রমিকেরা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছে...।’
ফোন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কথা শোনা যায় না।
আপনি কি পদত্যাগ করবেন, এই প্রশ্নটা আর করা হলো না।
কিন্তু রিয়ার কান্নাভেজা কণ্ঠটা ভুলতে পারছি না, দিয়া ব্যারিস্টার হতে চাইত।
দিয়া, রিয়া, রিয়াদ, তোমরা বড় হও। তোমরা এই রাষ্ট্রটার দায়িত্ব নাও। পুরা দেশটা একেবারে শৃঙ্খলাহীন হয়ে আছে। এইটাকে ভেঙেচুরে ঠিক করতে হবে।
একটা ফ্লাইওভার থেকে গাড়ি যেখানে নামবে, সেই ঢালে কীভাবে বাস থেমে যাত্রী তোলে, এই সহজ প্রশ্নটা আমরা কেউ করছি না।
দিয়া, রিয়া, রিয়াদ তোমরা এই প্রশ্নগুলো কোরো। এই ব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে ঢেলে আবার সাজাও।
দিয়া তো নেই। সে তো ঘুমোচ্ছে। মর্গে থেকে ফিরে ১৭ বছরের কিশোরী এখন মাটির নিচের অন্ধকার ঘরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার এই ঘুম তো আর কোনো দিনও ভাঙবে না।
কিন্তু এই রাষ্ট্রের কর্তাদের ঘুম কি ভাঙবে?