এমন মর্মান্তিক মৃত্যুই কি আমাদের পাওনা?
কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে পায়েল নামের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মারা গেছেন।
হয়নি। আবার বলি।
কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার সময় হানিফ পরিবহন নামের এক বাস সার্ভিসের চালক, সহকারী ও সুপারভাইজার ওই তরুণের মৃত্যু ঘটায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক জায়গায় বাস থামায় ছেলেটি বাথরুমে যায়। বেরিয়ে এসে দ্যাখে, বাস ছেড়ে দিয়েছে। দৌড়ে বাস ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে আঘাত পায়। নাক–মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে দেখে বাসের চালক তাঁকে—তাঁর জীবন নাশ করতে—সাহায্য করে।
কীভাবে?
নদীতে ফেলে দিয়ে। তাঁর লাশ পাওয়া যায় দুদিন পর।
*
গতকালের কথা। ঢাকায় এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে যাচ্ছি, দেখি ভীষণ জ্যাম লেগে আছে। এটা নিয়ে প্রথমে কিছুই ভাবিনি। ঢাকা শহরের জ্যাম কী, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এটা একটু অন্য রকম জ্যাম। দেখতে পেলাম মানুষজন ঘেরাও করে কী জানি দেখছে। আমরা ফ্লাইওভারের নিচে। ফ্লাইওভারের ওপর থেকে অনেক লোক দাঁড়িয়ে দেখছে কী হচ্ছে। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, তখন দেখলাম আর্মি নেমেছে—তাদের মাথার টুপি দেখে তা বুঝলাম। পুলিশ তো আগেই ছিল। এরপর দেখলাম ইউনিফরম পরা ছাত্রছাত্রীর ঢল। বুঝলাম ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বিবাদ, কিন্তু এটা কি কোটা আন্দোলন? গাড়ির বাইরে লোকজনের কথা শুনে মনে হলো, কেউ মারা গেছে। একটি বাচ্চা। এরপর শুনলাম দুটি বাচ্চা। ফ্লাইওভারের ওপর প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুই বাস মিলে নাশ করল দুই–দুটি বাচ্চার জীবন। তার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে তাদেরই সহপাঠীরা।
কিন্তু অবাক লাগল, আশপাশের মানুষের কথা শুনে। তাদের রাগ যেন ওই ছাত্রছাত্রীদের ওপর, যানজট সৃষ্টি করার জন্য। ওই তিন মৃত্যু যেন উছিলা। ‘দেখসেন রাস্তার দুই পাশই আটকায়া রাখসে’/ ‘দাখেন কত বাস ভাঙচুর করসে।’ নেতিবাচক স্বরে এ ধরনের কথা আশপাশে শুনছি। যাত্রীদের অনেকের পথে যেতে দেরি হলো, সেটাই যেন মুখ্য। আর কিছুই যায়-আসে না! মানুষের মানবিক বোধ কি তাহলে আর নেই? নিজেকে নিয়েই আমরা ব্যস্ত? আত্মকেন্দ্রিক এই জীবন কি আমরাই গড়ে তুললাম?
আর বাসচালকদের কথা কী বলব? দুদিন পরপর এসব ঘটনা তাদের কেউ না কেউ ঘটাবেই। তাদের প্রতিযোগিতায় রাজীব নামের একটি ছেলের হাত কাটা পড়ল, এমনকি ধুঁকে ধুঁকে ছেলেটি মারাও গেল। রোজিনা নামের আরেক ছাত্রীরও পা থেঁতলে গেল এবং জীবন গেল তারও। দোষী চালকদের কী হয়েছে? এত সাহস কে জোগায় তাদের? কীভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া তারা দিন পার করে? বাসের মালিকদের টনক কেন নড়ে না? কাকে পয়সা খাইয়ে রেখেছে তারা?
একটি দেশে আমরা যখন বাস করি, সেই দেশে নিয়মকানুন আছে বলেই আমরা জানি, সেই দেশে এমন মুক্তভাবে যখন মানুষকে মানুষ খুন করতে পারে, তখন আমাদের এমন ধরনের চরম হতাশার কথাই মনে হয়, হওয়ার-ই কথা।
আরও প্রশ্ন জাগে, এ রকম সহিংসতা কি ইদানীং বেড়ে গেছে? এটাও ভাবার বিষয়, এতগুলো মানুষ দেখল, এত ‘সাবলীল’ভাবে মানুষ মারা যায়! তাঁদের কি কোনো প্রতিক্রিয়া আছে? সপ্তাহে এ রকম কতটি মৃত্যু আমরা মেনে নিতে রাজি? আর কতটি দুর্ঘটনা নামের এই ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ ঘটলে মন্ত্রী মহোদয়, সরকার মহাশয় বুঝতে পারবে যে যথেষ্ট হয়েছে? জনগণ হিসেবে আমাদেরই বা মরার এবং সহ্য করার এবং শোক করার সীমাটা কোথায়?
এমন দেশ কি আমরা ছেয়েছিলাম? নাকি এমন অধিকারহীন জীবন এবং মর্মান্তিক মৃত্যুই আমাদের পাওনা ছিল?
নাদিন শান্তা মুরশিদ: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফালো, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক