দেশজুড়ে র্যাব-পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে ১০ দিনে ৫৪ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ২২ মে ও ২৪ মে রাতেই নিহত হয়েছেন ২৪ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪২ জনই মাদক ব্যবসায়ী। ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত বিরল। ফলে দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও সমালোচনা হচ্ছে।
মাদকাসক্তি জাতির অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন; প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে মাদকাসক্তি। ঠিক কতসংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বছরে বছরে তা যে দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় মাদকদ্রব্য, বিশেষত ইয়াবা বড়ি আটকের হিসাবের দিকে তাকালে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শুধু ইয়াবা বড়ি আটক হয়েছে ৪ কোটি পিস। এটা আগের বছরের তুলনায় ১ কোটি ১০ লাখ পিস বেশি এবং ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। অর্থাৎ গত সাত-আট বছরে এ দেশে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা ও সেবন বেড়েছে প্রায় ৫০ গুণ। সাধারণভাবে আটক মাদকদ্রব্যের পরিমাণকে প্রকৃত চোরাচালানের ২০ ভাগের এক ভাগ হিসাবে অনুমান করা হয়। সেই হিসাবে ২০১৭ সালে দেশে প্রায় ৮০ কোটি পিস ইয়াবা বড়ি কেনাবেচা হয়েছে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, এ দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কী বিশাল। উদ্বেগের বিষয়, মাদকসেবীরা মূলত তরুণ বয়সী; শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে একটা জাতিকে পঙ্গু করে ফেলতে পারে মাদক।
এই গুরুতর জাতীয় সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি কাজ; সে জন্য মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু মূলত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সাহায্যে বর্তমানে যে অভিযান চালানো হচ্ছে, তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। কোনো দেশেই এ ধরনের অভিযান স্থায়ী সুফল বয়ে আনেনি। সমস্যা দূর করতে হাত দিতে হবে সমস্যার মূলে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাই মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ।
প্রথম প্রশ্ন হলো, সারা দেশের শহর-বন্দর-গ্রামনির্বিশেষে মাদকদ্রব্য এত সহজলভ্য হলো কী করে? ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে। বর্তমানে সর্বাধিক জনপ্রিয় মাদক ইয়াবা আসে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে। কিন্তু কীভাবে আসতে পারছে এই অবৈধ পণ্য? আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো কী করছে? তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কি প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে ঢুকতে পারে?
সীমান্ত পেরিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করলে কোনো অভিযান চালিয়েই দেশের ভেতরে তার কেনাবেচা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। বন্ধ করতে হলে প্রথমে প্রবেশপথগুলোই বন্ধ করতে হবে, মাদকের জন্য সীমান্তকে শতভাগ নিশ্ছিদ্র করতে হবে। এটা করার দায়িত্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলোর। দ্বিতীয়ত, চোরাই পথে মাদকদ্রব্য আনা এবং দেশের ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে এক বা একাধিক শক্তিশালী চক্র কাজ করে। এই চক্রগুলো শনাক্ত করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
অভিযোগ আছে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পেশাদার অপরাধবৃত্তির সঙ্গে জড়িত লোকজন এসব চক্রের অন্তর্ভুক্ত। র্যাব-পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সেসব চক্র। চিহ্নিত ‘মাদকসম্রাট’ বা মাদক ব্যবসা জগতের রুই-কাতলাদের স্পর্শ না করে, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত না করে, খুচরা মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অভিযান চালিয়ে স্থায়ী সুফল আশা করা যায় না।