২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গণতন্ত্রের গাড়ির সব চাকাই সচল রাখতে হবে

আজ ২৬ মার্চ, স্বাধীনতার ৪৭ তম বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছিল, যা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। এর আগে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন স্বাধীনতা বলতে শুধু যে পাকিস্তানি শাসনকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল তা-ই নয়, সেই ভাষণে ছিল সার্বিক অর্থেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যয়।

৪৭ বছর পর আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করে দেখার সময় এসেছে, সেই সার্বিক অর্থে স্বাধীনতা আমরা কতটুকু অর্জন করেছি, কতটুকু করতে পারিনি। প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, গত ৪৭ বছরে আমরা যে অর্জন শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেই করেছি তা নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক অর্জন আছে, যা আমরা অনেক সময়ই আলোচনা করি না।

প্রথমত, পাকিস্তানি শাসনের ২৩ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ সময় আমরা ছিলাম সামরিক শাসনের আওতায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৪৭ বছরের বেশির ভাগ সময় বেসামরিক নির্বাচিত শাসনব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি আমরা। আমাদের দেশে সামরিক শাসকেরা পনেরো বছর সরাসরি এবং দুই বছর পেছন থেকে দেশ শাসন করেছেন। একটি দেশ গণতান্ত্রিক কি না, তার একটা মানদণ্ড হলো দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা কার হাতে রয়েছে-সামরিক বাহিনীর হাতে, না বেসামরিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে? এই মানদণ্ড ব্যবহার করলে বলতে হয় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে।

দ্বিতীয় যে অর্জন তা হলো আমাদের শাসকবর্গ, সামরিক কিংবা বেসামরিক এবং জনগণ উভয় পক্ষের কাছে এটা আজ প্রতীয়মান যে নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে হবে এবং টিকে থাকতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে সেখানে সামরিক বাহিনী শাসনভার গ্রহণ করে। ১৯৭০ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচন হয়, কিন্তু তার ফলাফলও পাকিস্তানি শাসকবর্গ মেনে নেয়নি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা গণহত্যার পথ বেছে নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মধ্যেই সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলেও ১৯৯১-এর পর থেকে আর তারা সেভাবে ক্ষমতা দখলের সাহস দেখায়নি। নির্বাচনই যে ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র পন্থা, সে ব্যাপারে আমাদের দেশে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। আর নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে আগ্রহ-উৎসাহও বেড়েছে। এটাও আমাদের আরেকটি অর্জন।

আমাদের তৃতীয় অর্জন নাগরিক অধিকার ও নাগরিক কণ্ঠস্বর। পাকিস্তান আমলে এই অধিকার একেবারেই সংকুচিত ছিল। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রার পর বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রসার ঘটতে থাকে। আগে যেখানে একটিমাত্র সরকারি বেতার-টিভি ছিল, সেখানে এখন অনেকগুলো বেসরকারি টিভি ও রেডিও আছে। বিশ্বব্যাংক, ফ্রিডম হাউসসহ বিভিন্ন সংস্থা জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে গণমাধ্যমকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শক্তিশালী উপাদান হিসেবে দেখছে। সাম্প্রতিক কালে সামাজিক যোগাযোগ ও ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জনমত প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। চাইলেই কেউ এসব বন্ধ করে দিতে পারেন না।

তবে এসব অর্জনের পাশাপাশি আমাদের অনেক ব্যর্থতাও রয়েছে। প্রথম ব্যর্থতা হলো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারিনি। নির্বাচিত দলের অধীনে নির্বাচন করতে বিরোধী দল চায় না। তারা অভিযোগ করে, যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অপর তিনটি দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ধারা প্রতিষ্ঠিত করেছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলো সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় থাকতে যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতেন, গণতান্ত্রিক আমলেও আমরা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ১৯৯৪-৯৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের ফলে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় তিনটি নির্বাচনও হয়েছিল, যার ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলও হয়। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেও দলীয়করণ করার প্রচেষ্টা করা হয়, যার ফলে দুই বছরের জন্য দেশ একটি সেনাসমর্থক সরকারের দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই সরকারই ২০০৮ সালের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, যার মাধ্যমে আবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু তারপর ২০১১ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আর মতৈক্যে পৌঁছাতে পারল না। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশ নেয়নি এবং ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতেছেন। এ কারণে দশম সংসদের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আমরা আরেকটি সংসদীয় নির্বাচনের সম্মুখীন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। আগামী নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ এবং সব দলের সমান অংশগ্রহণমূলক করা যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। নির্বাচনব্যবস্থা এবং নির্বাচনের ফলাফলকে আমরা কেমন করে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলব, তা আমাদের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।

আমাদের দ্বিতীয় ব্যর্থতা, আমরা আমাদের নাগরিক অধিকারকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ব্যক্তিস্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা প্রায়ই নানা রকমভাবে সংকুচিত হচ্ছে। কিছু হচ্ছে আইনের মাধ্যমে, কিছু হচ্ছে নানা রকম ভয়ভীতির মাধ্যমে। যখন ভয়ের সংস্কৃতি ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, যা আমরা ইদানীং লক্ষ করছি, তখন আলোচনা, বিতর্ক, ভিন্নমত পোষণ করা, যা গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।

আমাদের তৃতীয় ব্যর্থতা, আমাদের দেশে নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটা পরম সংঘাতময় রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। জয়ী ব্যক্তিরা বিজিতদের প্রতি অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক আচরণ করছেন। বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী জেলে যাচ্ছেন কিংবা মামলায় পড়ছেন। ‘আমাদের বিজয়ী দল সব পাবে’ (উইনার টেকস অল)-এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে দল হারছে, তারা প্রায় সর্বহারা হয়ে যাচ্ছে। সংঘাতের রাজনীতির ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যকার বিরোধ কখনোই রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু একটি ব্যবস্থা সব দলকেই মানতে হবে, যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সেই মতভেদ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা যায়।

আমাদের চতুর্থ ব্যর্থতা, আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারিনি। যদিও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে চারটি সংসদ-যেমন পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী দল সেই সব সংসদ বর্জন করেছে এবং রাজপথে আন্দোলন করে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিয়েছে। সংসদে একটি কার্যকর বিরোধী পক্ষের অভাবে আমরা সরকার প্রক্রিয়ার ভেতরে কোনো রকম ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি, যা গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম খুঁটিয়ে দেখা এবং এর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় সংসদ। সংসদীয় তদারকির অভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাহী বিভাগ উত্তরোত্তর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে।

আমাদের পঞ্চম ব্যর্থতা, আমরা আইনের শাসন কোনো দিনই প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। দলীয়করণের প্রচেষ্টার কারণে জনসাধারণের মনে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নিম্ন আদালতের প্রতি তেমন আস্থা নেই। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন জরিপে আমাদের এই দুর্বলতা প্রতীয়মান।

১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের নবযাত্রার পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে। বর্তমানে সেই ধারা আরও জোরদার হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এর পেছনে সরকারের যেমন অবদান আছে, তেমনি ব্যক্তি মানুষেরও উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে আমাদের সুশাসন ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। সুশাসন, বিশেষ করে আইনের শাসন এ জন্য প্রয়োজন যে আইন ঠিকমতো কাজ করলে দেশের মানুষ একধরনের স্বস্তি বোধ করে। ভাবে, আইন মেনে চললে তাদের কোনো ভয় নেই। আর আইনের শাসন না থাকলে অথবা ব্যত্যয় ঘটলে সমাজে অস্থিরতা ও ভয়ভীতি বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, কেউ তখন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বা উদ্যোগ নিতে চান না।

১৯৯১ সালের পর থেকে আমরা কেবল নির্বাচনী গণতন্ত্রটাকেই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াও গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদান আছে, যেমন মানবাধিকার এবং আইনের শাসন। এগুলো শক্তিশালী না হলে নির্বাচনী গণতন্ত্রও ঠিকমতো চলবে না। আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের একটি দুর্বলতা হলো নির্বাচনী রাজনীতিতে এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পায়। দল ও প্রার্থীকে এসব ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। তাই নির্বাচনী প্রচারে এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারটা যত গুরুত্ব পায়, ততটা পায় না সার্বিক গণতন্ত্রের উন্নয়ন বা সুশাসনের কথা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আচরণ কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই করা যাবে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা উপেক্ষিতই থেকে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আর আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির ‍উন্নতি কিংবা রাজনৈতিক সংস্কার সম্বন্ধে বিশেষ কথাবার্তা শুনিনি।

কিন্তু আমরা যদি সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন করতে চাই, তাহলে আমাদের সেই আলোচনা প্রথমে করতে হবে আমরা কীভাবে সব দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আচরণ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। গণতন্ত্রকে আমাদের একটি চার চাকার গাড়ির মতো ভাবতে হবে। এর একটি চাকা নির্বাচন। অন্য তিনটি চাকা হচ্ছে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও নাগরিক কণ্ঠস্বর। এক চাকায় গাড়িটি চলবে না, সব কটি চাকাই সুষ্ঠুভাবে চলতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্রের গাড়িটি সামনে এগোবে।

ড. রওনক জাহান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো