রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলায় পাহাড়ি জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালানোর এক মাস পার হলেও এখনো ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী নিজ নিজ বাস্তুভিটায় ফিরতে পারেননি। তাঁরা এখনো মানিকজোড়ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লংগদু নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তিনটিলা বৌদ্ধবিহার—এই তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র ও আত্মীয়স্বজনের ঘরবাড়িতে গাদাগাদি করে এই বর্ষাকালে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বই-খাতা, স্কুল ড্রেস ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী পুড়ে যাওয়ায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ঘটনার পরপরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশাসহ ১৪ দলের একটি প্রতিনিধিদল, জুম্ম উদ্বাস্তু পুনর্বাসন টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল সফর করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা তাঁদের দাবিনামাসংবলিত স্মারকলিপি মন্ত্রী, কর্মকর্তাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছেন। ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের নেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের স্থায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণ ও পুনর্বাসন করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও সরকার পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে এগিয়ে আসেনি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাড়ি নির্মাণ বাবদ যথোপযুক্ত অর্থ, কমপক্ষে তিন বছরের রেশন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, যথাযথ পুনর্বাসন, তাঁদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জুম্মদের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অচিরেই গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সর্বশেষ ২৩ জুন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা লংগদুতে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা তাঁদের দাবিনামা আবারও তুলে ধরেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি ৬ জুলাই লংগদুতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে গণশুনানি করতে গেলে তাদের কাছেও জুম্ম ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দাবিনামা পুনর্ব্যক্ত করেন। এর আগে ২৫ জুন লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ১ হাজার টাকা ও ২০ কেজি চাল দিতে চাইলে তাঁরা তা গ্রহণ না করে বলেছিলেন যে তাঁরা ছিটেফোঁটা ত্রাণ চান না। গুচ্ছ পরিকল্পনা ঘোষণাপূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দেওয়া হলে তবেই তাঁরা তা গ্রহণ করতে রাজি আছেন।
গত ২ জুন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলা সদরের তিনটিলা, পার্শ্ববর্তী মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যাপাড়ায় ‘বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা’ জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এতে ২৩৬টি বাড়ি ও দোকান সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয় এবং ৮৭টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনটিলা এলাকায় গুনমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধাকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় এবং হামলাকারীদের মারধরের শিকার হন অনেক জুম্ম গ্রামবাসী। হামলাকারীরা ঘরবাড়ি, দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র ও মালামাল, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি লুট করে নিয়ে যায় এবং শূকরগুলো মেরে ফেলে দিয়ে যায়। পুড়ে যাওয়া তিনটিলা, মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যাপাড়ার তিন শতাধিক পরিবার কেউই কোনো সহায়-সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেনি এবং এক কাপড়ে পালিয়ে কোনোরকমে জীবন রক্ষা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের তালিকা অনুযায়ী যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রাথমিক থেকে কলেজপড়ুয়া ২৫৬ জন ছাত্রছাত্রীর পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাসামগ্রী, পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পূর্ণরূপে আগুনে পুড়ে যায়।
১ জুন খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইল নামক স্থানে নুরুল ইসলাম নয়ন নামে ভাড়ায়চালিত একজন মোটরসাইকেলচালকের লাশ উদ্ধারের পর পাহাড়িরা তাঁকে হত্যা করেছে মর্মে অভিযোগ এনে জুম্মদের ওপর এই নারকীয় হামলা চালানো হয়। মোটরসাইকেলচালক নুরুল ইসলামকে যে বা যারা অপহরণ ও অপহরণের পর হত্যা করুক না কেন, তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় এবং হত্যার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢালাওভাবে নিরীহ পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা আরও বেশি নিন্দনীয় ও ঘৃণিত এ কারণে যে এটা ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এবং স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায়। সেদিন স্থানীয় পাহাড়ি জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকার মধ্য দিয়ে নিহত নুরুলের লাশ নিয়ে মিছিল করতে অনুমতি দিয়েছিল প্রশাসন। কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না বা কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাতে দেওয়া হবে না মর্মে পুলিশের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও সেই মিছিল তিনটিলা এলাকার কাট্টলতলায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের উপস্থিতিতে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুট করতে শুরু
হয় এবং পেট্রল ও কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেই সময় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারীদের কোনো ধরনের বাধা দেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ছত্রভঙ্গ করার জন্য ফাঁকা গুলি ছোড়েননি বা কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেননি। বরং হামলা ও অগ্নিসংযোগকারীদের জুম্ম গ্রামবাসী প্রতিরোধ করতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধকারী জুম্মদের ধাওয়া করেন এবং বন্দুক তাক করে গুলি করার হুমকি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নুরুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে সেদিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতৃত্বে, যেখানে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক সংগঠনের নেতারাসহ লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও অংশ নেন ও বক্তব্য দেন। সেদিন রাতে মাইকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাত্যাপাড়ায় সমবেত হতেও আহ্বান করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এ থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সব উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি এককাট্টা হয়ে জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পরিকল্পনা নিয়েই লাশ নিয়ে জঙ্গি মিছিলের আয়োজন করেছিল। আমরা এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারের কাছে জোর তাগিদ জানিয়ে কিছু দাবি রাখছি:
এক. নুরুল ইসলাম নয়ন, গুনমালা চাকমা জুম্মদের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে জড়িত সব ব্যক্তিকে অচিরেই গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে; দুই. ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের জন্য অচিরেই গুচ্ছ পরিকল্পনা ঘোষণা করে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ও পুনর্বাসন করতে হবে; তিন. ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীদের জরুরি ভিত্তিতে বইপুস্তক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন সুনিশ্চিত করতে হবে; চার. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ, দ্রুত ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
লেখকবৃন্দ: মানবাধিকারকর্মী, গবেষক, চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।