সৌমনা দাশগুপ্তর কবিতা

।। ইচ্ছেগাছ ।।

এই সেই গোলাঘর, ঘুলঘুলিতে কামনা বসানো

#

আমি কি রোদের দিকে চলে যাব
পুষ্পপাত্রে রেখে দেব ধাতুর যাতনা

#

ব্যাধ কথা বলে যায় সারা দিন
নিজেকেই তাক করে ছুড়েছি ধারালো ভল্ল

#

উন্মার্গগামী

#

হোমানলে উচ্ছ্বসিত ঘৃত ও কর্পূর

#

খোলশ বদল করে দেহবীজ
ইচ্ছেগাছে ঢেলে দেয় জল ও প্রদাহ

।। চন্দ্রপাত।।

গচ্ছিত রেখে দেব ঋণ, বৃষ্টিভেজা যত দেশলাই।

#

আমার গতজন্মের না-নেভা কলকে
আমার মগজভর্তি ছাই

#

ফিরে আসি, ফিরে ফিরে আসি
বৃশ্চিক-রাশির লগ্নে যেই ঢেউ উঠেছিল
সাগর নেয়নি তাকে

#

সাগর তো কিছুই নেয় না কোনো দিন

#

সবটা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যায়;
কর্কটরেখায় এসে ফুলে ওঠে মৃতদেহ শুধু

#

দ্যাখো, তার দেহের ওপর বসে আশ্চর্য শকুন!

#

এইখানে শুধু চন্দ্রপাত
এইখানে মেঘের চেয়েও বেশি বড় তার ছায়া 

#

আর দ্যাখো, শূকরীর প্রসবদৃশ্যের মাঝখানে এক বোবা জাদুকর 

#

ডানা মেলে দিয়ে তার উড়ে যাচ্ছে দিকচক্রবালে

#

পেরেকে পেরেকে লেখা ময়ূরের ক্লিন্ন বেদনা

।। লালিগুরাশের দিকে।।

 চরম শ্রাবণ হয়ে ঝরে যায় দিন
লাল চাঁদ, খুলিগুহা, সুবর্ণ বালুকাভরা জমি

#

বেল, জুঁই, চামেলি বা চাঁপার ফুলের রেণু, সব
বেদম হাউশ ফেলে লালিগুরাশের দিকে চলে যাব

#

এসো আজ গুহাশিল্পের কথা বলি
বলি সেই সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গকথা
অন্তিম ঝাউবনে ঢুকে যাক অ্যালবাট্রস পাখিটি আমার

#

সেই দিন রাস্তাও পথ হবে, কালো ও পিছল সেই পথে ফোঁটা ফোঁটা
রাবারগাছের ঘু্ম। লেখো মোম, লেখো রাত্রি, লেখো বোলতার ধুন

#

প্রতিটি ব্যথার পর হংসধ্বনিতে ছড় টানো
ব্যাকুল এসরাজ থেকে আদিতম স্বর

।। চেরাজিব ।।

সাপ খেলাতে খেলাতে সেই বেদে একদিন দুধ ও মধুতে রাখে চেরাজিব, হিরণ্ময় ছাই। তার হাতে অমৃতফল, মেধা ও খনির থেকে তুলে আনা লৌহবাকল।
দ্যাখো তার অলীক চামড়া থেকে খুলে গেছে প্রত্নদিনের গান, ঋতুআহ্লাদ। আমি তাকে আতশকাচের নিচে বড় করে দেখি, দেখি সেই গুলালের দিন থেকে খসে যাওয়া চাঁদ ও সূর্যের রসে বুড়ো এক মহাবুড়ো লোকগল্পের সুর অতিজাগতিক কোনো ডিম হয়ে বসে আছে, আমার মাছের পেটে তমোগুণ হয়ে বসে আছে। নিছকই একেকটা দিন শুধু রক্তক্ষরণ হয়ে ভেসে যায়। ঘোড়াদের পায়ে পায়ে ধুলোর রেণুতে তার দাগ লেগে গেছে।
এইখানে খেলা জমে ওঠে। এসো সুবাতাস এসো, দোলা দাও সাপটিকে, ঝাঁপির ভেতর থেকে টান মেরে বের করে আনো, যা কিছু জমানো ছিল অহল্যা দিনের কাছে, রাত্রির পাঠাগারে পড়া হোক সেই পুঁথি, আমার ঘুমের মাঝে সুর হয়ে বেজে যাক সে প্রলাপ, আমার ঘামের সুরে সে-ও যেন অনাবাদি স্রোত হয়ে আগুন জ্বালাক।
প্রতিরাতে খুন হয় চারাগাছ, প্রতিরাতে নির্বিবাদী সেই এক কুপির আগুন থেকে ঘোর দাবানল, পুড়ে যায় মোহরং এ লিবাস, আমি শুধু একটা একটা করে পৃষ্ঠা উলটে দেখি চেরাজিব ফুঁসে ফুঁসে ওঠে

।। চাবুকের দাগ ।।

চাঁদলাগা দিলের জিকির। বাতায়ন ঘিরে ঘিরে টাঙিয়ে দিয়েছি যত বেশুমার মেঘ। রংচটা, তারকাটা মেঘ এসে ঢুকে যায় প্রাণের ভেতর। পাখির শহর থেকে গানওয়ালা, ভাঙাচোরা বাঁশি তার সুর তোলে। যেন সাইরেন এক, পাগলাঘণ্টি বেজে ওঠে। আমি কি জলকে যাব, কলসি ও দড়ি সমাহারে!
এ তো এক তেলেসমাতির কারবার, রূপকথা ছিল, নাকি হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে লেখা ছিল চুমু! চারকোল শেডে আঁকা দরিয়ার শব। মৃত ঢেউ, বোবা ঢেউ, অম্ল ও ক্ষার দিয়ে রচিত এ শিরোনামে খবর আঁটে না। গল্পের খাঁজেখোঁজে বেকার বেকার শুধু জল ঢুকে যায়। কেশরের উলোঝুলো ডাক, ব্যারাক-ঘরের থেকে হ্রেষারব, কতদিন হয়ে গেল, আমার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়নি কোনো নিশিডাক। মাটি খসে, মাটি ধুয়ে যায়, নদীর শরীর জুড়ে চাবুকের দাগ

 ।। বঞ্জর মেঘ ।।

দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বলে এখানে আকাশ মেঘলা। সেই এক কাঙাল ঘাসের জন্য মাঠের নাব্যতা। সেই ঘাসে ফকির বসত করে, সেই রসে জারিয়ে উঠছে কামরাঙা। সেই মাঠে পরাছবি, ডাল নেই, পাতা আছে, খসে পড়া পাতার সুফিয়ানা।
এই ভিতরমহল, এই যে অন্দরকথা, এখানেই আমার তীর্থ গো সাঁই। স্রোত কথা বলে সারা দিন। আমার হলো না যাওয়া। এত বলি, গোলাপ খুলেছি, এসো পাখিডাক, এসো ভ্রমরকূজন। শুধু শুধুই হাওয়া হয়। পাখিটি ওড়ে না। এ কী পরবাস, বজ্ররঙের ঢেউ, ভিজে গেল কাগজের নাও।
সখী তারে বলে দিয়ো, আমার যে মোকাম হলো না। বঞ্জর এই মেঘ জানে না জলের ঋতু, বারবার সাঁকো ভেঙে যায়। একদিন চলে যাবে পুষ্পপাত্রের যুগ, ধুলোর বেহালা থেকে খুলে যাবে মধু ও লবণ। অনাবাদি পড়ে আছে নদী, বীজরূপ সফল হল না। এই ফুলে চার চার রং, এ জাহাজে আগুন ও পানি, সখী মোর ফলরূপ সাকার হল না

 ।। মৃদু প্রজাপতি ।।

দ্যাখো, তাকে জুম করে দ্যাখো। মরিচা রঙের চাঁদ, দমকুঠুরির মাঝে, বিহানকালে। তুমি নাকি রঙের ব্যাপারি ছিলে চিঁড়ে কুটবার দিনে, জল তোলা, জল ফেলা রাতের আড়ালে! ডুবুরিও ছিলে, ছিলে নাকি, হাওয়ার ঘরের মাঝে ফাঁদ পেতে তুলেছ কি স্বপ্নফুল, ব্রহ্মকমল? তাকে আমি শমন বলেছি। সেই চিঠি ধুলো হয়ে মিশে আছে এই ঘরে, তাই তো এ ঘরে আজও ঝাঁটও পড়েনি। ব্যাধ ফিরে এসে দ্যাখে, পড়ে আছে একটি-দুটো মৃত হাড়গোড়, এখনো তাদের গায়ে মাংসের দাগ। এই পথে তিলে তিলে হয় গো সাঁতার।
জল আসে, নদী আসে, আঠালো বসতে ডোবে মৃদু প্রজাপতি।