আমার কবি হেলাল হাফিজ

কবি হেলাল হাফিজ এবং চিত্রশিল্পী ধ্রব এষ
কবি হেলাল হাফিজ এবং চিত্রশিল্পী ধ্রব এষ

হেলাল হাফিজ: ১৯৮৬
চোখের সাদা অংশে জবা ফুলের রং ধরিয়ে রাখেন।
এই কবি খুব রাগী।
বইমেলায় দেখি, কথা বলি না। দ্বিধায় বলি না।
খালিদ আহসানের প্রচ্ছদে, কবির একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে বইমেলায়।
যে জলে আগুন জ্বলে।
কিনেছি। অটোগ্রাফ নিইনি। জবা ফুলের রং ডরাই।

হেলাল হাফিজ: ১৯৮৮

রঙিন হৈ হল্লার দিন সেসব।
উড়ে কেটে যায়, পুড়ে কেটে যায়।
ধোয়ামগ্ন এক উদ্যানের দুপুর। ক্ষুধা লেগে গেছে, পকেটে টাকা নাই। একজনের পকেটেও নাই।
ইয়াসিন বলল, ‘চল, প্রেসক্লাবে যাই। ’
মাসুম বলল, ‘লও যাই। ’
প্রেসক্লাবে কী? ভাত মিলবে?
রোদের উদ্যান থেকে প্রেসক্লাব, হাঁটা দুরত্ব তখন। না হলেও হাঁটতেই হতো। এছাড়া ঋষি ঔতরেয় ‘চরৈবেতি’ বলেছেন। আগে বাড়ো। সেটা চক্রযানে নাকি হেঁটে?
পায়ের তলার পথ ফুরালো লহমায়।
প্রেসক্লাবের রিসেপশন।
ইয়াসিন বলল, ‘আমরা হেলাল ভাইয়ের কাছে আসছি। ’
‘উনি তো খাইতেছেন। ’
‘আমরাও খাব। ’
‘জি? ’
‘না, বললাম অসুবিধা নাই। উনারে খবর দেন, মোক্তারপাড়ার ইয়াসিন আসছে। ’
স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, রিসেপশন পার হতেই দেখা গেল কবিকে। খুবই মনোযোগ সহকারে খাচ্ছেন। অন্যমনস্কভাবে তাকালেন। নেতাদের মতো হাত তুলল ইয়াসিন। কবিকে আশ্বস্ত করল ‘আমরা আসছি’? কবি কি আশ্বস্ত হলেন? তবে দেখলেন। ইয়াসিন তার প্রেমিকার পাড়ার, আবার কবিও। কবির সিগন্যাল বুঝল। বলল, ‘আয়, বসি। ’
পরম যত্নের সঙ্গে কবি খাচ্ছেন।
বাংলা সাহিত্যের কোনো বড় কবিকে এই প্রথম আমি ভাত খেতে দেখলাম। বড় কবিরা ভাত খান না তা নয়, দৃশ্যগত দিকটার কথা বলছি। ফ্লাশব্যাকে যেতে হয় না, এখনো সেই দৃশ্য দেখতে পাই।
অন্নগ্রহণ করে কবি উঠলেন।
নিকটবর্তী হলেন ক্ষুধার্ত তারুণ্যের।
ইয়াসিন নেত্রকোনার মোক্তারপাড়ার। মাসুমও নেত্রকোনার। সাতপাইয়ের। আমি বললাম, ‘আমি উকিলপাড়ার। ’
নেত্রকোনায় একটা উকিলপাড়া আছে। আমাদের সুনামগন্জেও একটা উকিলপাড়া আছে। দেশে আরো অনেক উকিলপাড়া আছে। থাকুক। আমরা ক্ষুধার্ত।
ইয়াসিন বলল, ‘দুপুরে আমরা কিছু খাই নাই। ’
কবি বললেন, ‘কী খাবি তোরা? ’
ইয়াসিন বলল, ‘ভাত। ’
‘ভাত তো এখন এইখানে পাবি না। ক্যান্টিনে আগে বলে রাখতে হয়। পুরি খাবি? পুরি দিতে বলি? ’
‘খাব। ’
কবি বারটা পুরি দিতে বললেন। আলুপুরি না ডালপুরি মনে নাই।
বারটা পুরি রেখে গেল এবং পাতে না পড়তে উধাও। ক্ষুধার্ত তারুণ্য। কবি আরো বারটা দিতে বললেন। আরো বারটা। এরপর চা। ওম শান্তি! কবির সঙ্গে দুনিয়ার কথা হয়ে গেল এক বেলাতেই।
কবি কবির মতো। কবি স্নেহশীল। ছায়ার গাছ এক। আমরা নিশ্চিত করে জেনে গেলাম আমাদের বাকি জীবনের জন্য। আমাদের, আমার হেলাল ভাই আছেন। কবি হেলাল হাফিজ। অবশ্যপাঠ্য ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবি।
চোখের লাল রং শুধু রাগের না, দুনিয়ার মায়ারও।
আমরা তিনজন পা স্পর্শ করে সালাম করলাম হেলাল ভাইকে, প্রেসক্লাব ছাড়লাম এবং মিশে গেলাম নগরীর উজ্জ্বল-অন্ধকার সন্ধ্যায়।
বহুদিন আর যাইনি আমাদের এক দুপুরের অন্ন(?)-দাতা সকাশে।
এতদিন পর কী মনে হয়?
ইয়াসিনের কী মনে হয় জানি না। ‘পোশাক বাউলের অন্তর গরুর দালালের’-কাব্যগ্রন্থের কবি ইয়াসিনুর রহমান। অসুস্থ সে। নেত্রকোনায় আছে। মাসুম ঢাকায়। মাসুম পারভেজ। আমাদের দেখা হয়। হেলাল ভাইকে নিয়ে কথা হয়। আমরা বার বার সেই দুপুরে ফিরে যাই।
আহ! হেলাল ভাইকে আমার আশ্চর্য বিষণ্ন সুন্দর এক পাথর মনে হয়। নদী ছিল, পাথর হয়ে গেছে। সেই পাথর। নদী তার ভেতরে বহমান। আত্রেয়ীর মতো অন্তঃসলিলা।

হেলাল হাফিজ: ১৯৯৩-৯৪
অদ্ভুত আঁধার এক। মাতৃগর্ভের যে অন্ধকার। আমার এক দার্শনিক বন্ধু বলেন, এই অন্ধকারেই ঠিকঠাক হয়ে যায় সব। এ কবি হবে, এ খুনি। কবিজন্ম সব সময়ই ঈর্ষাযোগ্য। চিরকালীন একটা কথা বলে চলে গেছেন এক মিলু দাশ, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। ’ কবিজন্ম তবে আলাদা।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
কোথায় পড়েছেন?
বইয়ের পাতায় নাকি দেয়ালে?
গ্রাফিতি আর চিকা মারা কি এক? এক না হলেও এক গোত্রের। গ্রাফিক অ্যাজিটেশন। বাংলা আর কোনো কবিতার লাইন নিয়ে মনে হয় এতবার গ্রাফিক অ্যাজিটেশন হয়নি। আমাদের আগের মানুষজন দেখেছেন, আমরা আশি-নব্বই-এর দশকে দেখেছি দেয়ালে দেয়ালে, এখন যৌবন যার. . . ফুটে আছে শিমুল ফুল লাল রঙের অক্ষর। সে গত শতাব্দীর ঘটনা। গ্রেগরিয়ান শতাব্দী। সত্তর, আশি এবং নব্বই, তুমুল তিন দশক ছিল কবিতার। হেলাল ভাই তখনই কিংবদন্তী। আড্ডার, কানাঘুষার, ফিসফাসের মানুষ হয়ে গেছেন। আগন্তুকের মতো রহস্যময় কেউ। আমাদের দেশের কোন কোণায় না উড়ে গেছে সেইসব শব্দাবলি।
নিউট্রন বোমা বোঝো,
মানুষ বোঝো না
কষ্ট নেবে কষ্ট. . .
আমিও গেরামের পোলা. . .
কবিতা এবং জনপ্রিয়। সরল সিধা হিসাব বিবেচনা। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কত কপি বিক্রি হয়েছে? সঠিক হিসাব আছে? বিক্রি হয়েছে এবং হচ্ছে। এত বছর ধরে একদম নতুন আর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি হেলাল হাফিজের। তাতে কী? ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ তরুণরা পড়ে এখনো। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের যে কোনো কবিতা।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘অনিন্দ্য’ প্রকাশনা থেকে। পরে ‘দিব্যপ্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বর্তমানে দ্বাত্রিংশ মুদ্রণ চলছে। ‘দিব্য’-র দুটো মুদ্রণের প্রচ্ছদ আমি করেছি। দ্বিভাষিক সংস্করণেরও। যুবক অনার্য ইংলিশ অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ ভালো হয়েছে কিনা বলার মতো ইংলিশ বিদ্যা আমার নাই। দেবাশিসদা বলেছেন ভালো হয়েছে। দেবাশিসদা ইংলিশের জাহাজ। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নিশ্চয় আরো নানা ভাষায় অনুদিত হবে।
ধান বানতে শিবের গীত বলে আর কাকে? এই শীতের রাতে জলে পড়েছি, যে জলে আগুন জ্বলে। না হলে আমার লেখার কথা শুধু হেলাল হাফিজের বইয়ের প্রচ্ছদগুলো নিয়ে, যে প্রচ্ছদগুলো আমি করেছি।
হেলাল হাফিজের বইয়ের সংখ্যা?
দুই যোগ দুই চারটা। দুটো দ্বিভাষিক। চারটা বইয়ের প্রচ্ছদই আমি করেছি। সে সব প্রচ্ছদ নিয়ে কী লিখব, প্রচ্ছদেই লেখা না হয়ে থাকে যদি। গতবছর এক জাতকবি আমার বানানো তার একটা বইয়ের প্রচ্ছদ এই বিবেচনায় বাতিল করেছেন যে তার কবিতা আমি বুঝতে পারি নাই। নায্য কথা। সব কবিতা আমি কী করে বুঝব? সেটা দুরূহ। তবে হেলাল হাফিজের কবিতা মনে হয় নিজের মতো করে বুঝি কিছুটা। আশ্চর্য বিষণ্ন সুন্দর পাথরের নীল, সোনালি, লাল, ধূসর রং বুঝি।

হেলাল হাফিজ: ১৯৯৬-৯৭
‘অচল প্রেমের পদ্য’। হেলাল হাফিজ।
কবিতার কার্ড। বারটা কবিতার প্যাকেট।
খালিদ আহসান অলংকৃত।
এমন জিনিস আগে দেখি নাই। অভিনব।
‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্রথমে কত প্যাকেট ছাপা হয়েছিল?
এত সচল প্রেমের পদ্য আর হয়েছে? প্রকাশকাল আমার মনে নাই। ১৯৯৬-৯৭ এর কোনো একদিন কথা হলো মাধবদার সঙ্গে। ত্রয়ী প্রকাশনের মাধব চন্দ্র দাস। ‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্যাকেটটা মাধবদা আবার ছাপবেন। আমি কি অলংকরণ করব? অবশ্যই।
মাধবদা তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে কবি হেলাল হাফিজ সম্পর্কে বললেন। অত্যন্ত খুঁতখুতে মানুষ। অলংকরণ থেকে টাইপ সেটিং পর্যন্ত সব তাকে দেখাতে হবে। ঠিক আছে। দেখাব। মাধবদাকে আর কিছু বললাম না। শংকা ছিল, এতদিন পর, আমাকে মনে রাখার কথা কি হেলাল ভাইয়ের? কেন মনে রাখবেন?
বইয়ের গ্রাফিক্সে তখনো কম্পিউটার ঢুকেনি। কী-ড্রয়িং করে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং রঙিন অলংকরণ করতে হতো। বারটা কার্ড ড্রয়িং করলাম, কী-ড্রয়িং করলাম, কালার চার্ট করলাম। টাইপ কম্পোজ হলো ফটোকম্পোজে। মাধবদার সঙ্গে গেলাম কবিকে দেখাতে। কবি প্রথম আমাকে দেখলেন, ‘আরে! তুই! ’
হ্যাঁ আমি। আপনার আমি।
‘অচল প্রেমের পদ্য’ ছাপা হলো আবার। আমার প্রচ্ছদ এবং অলংকরণে। নিশ্চিত তবে। আমার জন্য স্নেহমায়ার এক অন্তঃসলিলা নদী কিংবা চিরহরিৎ গাছ, সবসময় আছেন এই নগরে।