গালে হাত দিয়ে পুকুরের ধারে বসে থাকে ফাতেমা বানু। নিজের সঙ্গে কথা বলা তার প্রিয় অভ্যাস। তার কাছে পুকুরের ধার এমন এক সুখের জায়গা, যেখানে এসে বসলে না বলা কথা জলের মতো কলকল শব্দ করে বুকের ভেতর।
আজও তেমন হচ্ছে। গাল থেকে হাত সরিয়ে দুহাঁটুর ওপর দুহাত রাখে ফাতেমা বানু। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে, তুই কী করিস, বাজান? আমার কোলে আয়। আমার কাছে তো তুই বড় হয়ে যাসনি। হ্যাঁ, তাই তো। আমি তো ওকে বড় ভাবি না।
কিন্তু ও যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করার কথা বলে।
বলে তো।
হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে ফাতেমা বানু চারদিকে তাকায়। স্নিগ্ধ সবুজ গাছগাছালির গায়ে ওর দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। চোখ ফেরাতে পারে না। মগ্নতায় ডুবে যায় ওর পঞ্চান্ন বছরের জীবন। দেখতে পায় সবুজ পাতার ওপর ভেসে উঠেছে স্বামী তোরাব আলীর চেহারা। মৃদু হাসছে যেন। তোরাব আলী দুদিন আগে ধান নিয়ে মাখনখোলা বাজারে বিক্রি করতে গেছে। আজ ফিরবে। তাই দুপুরের আগে রান্না শেষ করার জন্য চুলোয় আগুন দিয়েছিল। দাউ দাউ জ্বলে ওঠা চুলোয় আগুন দেখার সময় নিজের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। এখন পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকলে অজস্র শব্দ ওকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। নিজেকে বলে, আমি তো নিজের মতো আগুন জ্বালাই। আগুন নিজের মতো জ্বলে। তবে আজকে আগুনের চেহারায় যুদ্ধের ছবি ছিল।
যুদ্ধ? তুমি কি আগে যুদ্ধের ছবি দেখেছ?
দেখিনি তো।
তাহলে যুদ্ধের ছবির কথা বলছ কেন?
এখন যে সময় মুক্তিযুদ্ধের।
ও হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
নিজেকে নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয় ফাতেমা বানু। রান্না শেষ করার জন্য দ্রুত উঠে আসে রান্নাঘরে। ছেলেটা ঘরে আছে। এখনো এসে বলেনি, মা, ভাত দাও। খিদে পেয়েছে মা গো।
না, ছেলেটা দরজায় এসেও দাঁড়ায়নি।
ফাতেমা বানু স্বস্তি বোধ করে। চাল ধুয়ে ভাতের হাঁড়িতে ভরে চুলায় আগুন জ্বালায়। শুকনো খড়ির আগুন দাউ দাউ জ্বলে উঠলে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। নিজেকে বলে, এমন আগুন তো রোজই দেখি। আজ মনে হচ্ছে আগুন খুব সুন্দর। এমন আগুন দেখলে নিজের শরীরে বল বাড়ে। এখন তো শরীরে বল বাড়ার সময়।
চারদিকের বাতাসের কাছ থেকেও এমন কথা শুনতে পায়। চুলায় ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে দেয়। একটু পর টগবগিয়ে উঠবে পানি। বলক উঠবে ভাতের হাঁড়িতে। সেই ফুটন্ত পানির দিকে তাকিয়ে থাকলে রক্তেও বলক ওঠে। শক্তি বাড়ে। ফাতেমা বানু এই ভাবনার সঙ্গে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঠানে ঘুরে বেড়ানো হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, তোদের শরীরে বল বাড়ার দরকার রে। ডানা মেলে ঘুরে বেড়াবি সারা দেশে। আমার ছেলে যেখানে যুদ্ধ করবে, সেখানে চলে যাবি। ওপর থেকে দেখবি ওকে। তারপর আমাকে এসে বলবি, তোমার ছেলে সাহসী বীর। আমি তোদেরকে ধান খেতে দিলে আমাকে গান শোনাবি, মারুফ, মারুফ, বীর মারুফ, মুক্তিযোদ্ধা মারুফ।
তারপর ধান খাওয়া শেষ করে আমার পায়ে মাথা রেখে বলবি, তোমাকে স্যালুট করি, বীরের মা।
তখন হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক ধ্বনিতে উঠান মাতিয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। হাঁসের ডাকের ধ্বনি শুনতে শুনতে প্রাণ খুলে হাসে ফাতেমা বানু। হাসির শব্দে হাঁসগুলো ডানা ঝাপটিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালে ফাতেমা ওগুলোকে কাছে টানার জন্য বসে পড়ে। দুহাত বাড়িয়ে ওদের পিঠে হাত বোলায়। ছোট দুটোকে কোলে তুলে নেয়। শাড়ির আঁচলে ঢেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে বলে, তোরা এখন আমার কোলের মানিক। তোরা আমার ছোট্ট মারুফ।
তখন শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মারুফ। দরজায় দাঁড়িয়ে মাকে দেখে। উঠোন পেরিয়ে ঢুকতে হয় রান্নাঘরে। কিন্তু মা যেভাবে হাঁসগুলোকে নিয়ে মেতে উঠেছে, তা দেখে ওর আনন্দই হয়। ও জানে, ওর মা পশু-পাখিকে খুব ভালোবাসে। ওদের যত্ন করতে মা কখনো হয়রান হয় না। তখন ও শুনতে পায় মায়ের কণ্ঠের মৃদুস্বরের গান, ওরে তোরা আমার সঙ্গে গান কর—মারুফ, মারুফ, বীর মারুফ, মুক্তিযোদ্ধা মারুফ।
মায়ের গান শুনে চমকে ওঠে মারুফ। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। ওর চোখের পলক পড়ে না। মায়ের এমন চেহারা ওর কুড়ি বছর বয়সের জীবনে দেখা হয়নি। আজ ওর সামনে অন্য মা। মাটির ধাপ পেরিয়ে উঠানে নামার জন্য ওর পা নড়ে না। ভাবে, মা ওর দিকে ঘুরে তাকাক। বলুক, কী রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভাত খাবি না?
মায়ের কণ্ঠের গুনগুন ধ্বনি তখনো ভেসে আসছে। ও দরজার গায়ে হেলান দেয়। মাটি দিয়ে তৈরি ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে ও পুরো দেশের মাটি অনুভব করে। ভাবে, স্বাধীনতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় মায়েরা কি অন্য রকম হয়ে যায়? ওর মনে হয় উঠানের চারপাশের বড় বড় গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু দোলা। বৈশাখের দাবদাহ শীতল করার চেষ্টা করছে। মা কি ঠান্ডা পরশ পাচ্ছে নাকি গরমে—ভাবনা শেষ হওয়ার আগে ফাতেমা বানু হাঁস দুটো উঠানে ছেড়ে দেয়। ভাতের হাঁড়িতে বলক উঠেছে। উঠে দাঁড়ানোর সময় দেখতে পায় মারুফকে। হাসিমুখে তাকিয়ে বলে, কী রে বাজান, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খিদে লেগেছে? আয়, এখুনি ভাত দেব।
মারুফ নেমে আসে উঠানে। হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে দৌড়ে অন্যদিকে চলে যায়।
মা ভাত হয়েছে?
হ্যাঁ রে, বাজান দেখি।
আব্বা কখন আসবেন?
এখনই তো আসার কথা।
আমি বাইরে গিয়ে দেখি আব্বা আসেন কি না। তাহলে দুজনে একসঙ্গে ভাত খাব।
দুইজনে খাবি?
না না, তিনজনে খাব। আপনিও আমাদের সঙ্গে খাবেন।
ফাতেমা বানু মৃদু হেসে রান্নাঘরে ঢুকে ভাতের হাঁড়িতে খুন্তি ঢোকায়। বেড়ার ফাঁকে দেখতে পায় মারুফ উঠোন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। ফাতেমা বানু আবার দরজায় এসে দাঁড়ায়। গাছের ফাঁকে ও আড়াল হয়ে গেলে তার চোখে পানি আসে। গাল বেয়ে পানি গড়াতে দেয় ফাতেমা বানু। মারুফের তিন বছর বয়সের সময় মেয়ে বিনুর জন্ম হয়েছিল। মেয়েটি এক বছর বয়সে কলেরায় মারা যায়। দুই বছর পরে জন্ম হয় মিনুর। তিন বছর বয়সে পুকুরে পড়ে মরে যায় ও। সারাক্ষণ পুকুরের পাড়ে খেলতে ভালোবাসত। ফাতেমা বানু চোখে চোখে রাখত মেয়েকে। তারপরও ঘটনাটা ঘটে গেল। মারুফও স্কুল না থাকলে সারাক্ষণ ওকে নিয়ে থাকত। ছেলেটি গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিল। সারাক্ষণ বলত, মা গো, ওকে আমি কবর থেকে তুলে আনব। ও মাটির নিচে কেন থাকবে? আমি থাকতে দেব না। একদিন রান্নাঘরের বঁটি নিয়ে কবর খুঁড়তে গিয়েছিল ও।
সেদিন ওর আব্বা ওকে ঘাড়ে তুলে বাড়িতে এনেছিল। ছেলের কান্নাকাটি থামাতে না পেরে নিজেও বুক ফাটিয়ে কেঁদেছিল। বলছিল, আমাদের ভাগ্যে মেয়ে নাই। মেয়ে দুটোর জন্য লোকটা প্রায়ই কাঁদে। নামাজ পড়ার সময় ওদের জন্য দোয়া করে। ফাতেমা বানুও নামাজ পড়ে দোয়া করে ওদের জন্য। কিন্তু দুঃখ একটাই যে ওদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হলো না। মারুফ একা একা বড় হয়ে গেল। ছেলের সামনে এখন যুদ্ধের সময়। ফাতেমা বানু উঠানের ধারে এসে দাঁড়িয়ে ছেলেকে খোঁজে। দেখতে পায় ওর সঙ্গে যাচ্ছে পাশের ঘরের দুই ছেলে নাটু আর বটু। দুজনই মারুফের ভক্ত।
মারুফ ওদের কাছে টেনে আদর করে বলে, তোরা আমার দুই বোন বিনু আর মিনু।
হুত, আমরা বোন হব কেন? আমরা তো ছেলে।
ভালোবাসার বোন তোরা। ওরা যে মরে গেছে, ওরা তো আমার কাছে নাই, তোরা আছিস। তোদের আমি ওদের মতো ভালোবাসি।
জানি, জানি। কিন্তু আমরা তোমার বোন হব না। আমরা তোমার ভাই।
হুত, ভাই না ছাতু। দেব এক থাপ্পড়।
ওরাও রেগে যায়। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে, দিয়ে দেখো থাপ্পড়। আমরাও তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।
এসব কথা থামানোর জন্য ফাতেমা বানু ওদের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। নাটু–বটুকে আদর করে বলে, আয়, পিঠা খাবি। তোদের আমরা বিনু–মিনুর মতো ভালোবাসি। চল, হাঁসের ডিম দেব। তোরা মারুফের সঙ্গে রাগ করবি না।
পিঠা খাব, পিঠা খাব। হাঁসের ডিম নেব। দুভাই লাফালাফি করেছিল।
মারুফ তোদেরকে বোনের আদর দেবে। তোরা কিন্তু রাগ করবি না। যদি তোদের বিনু–মিনু ডাকে, তাহলে বলবি, ভাইয়া। মনে থাকবে তো?
হ্যাঁ, থাকবে।
দুভাই হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকিয়ে ছিল। সেই থেকে ওদের আর কোনো বিরোধ হয় না। এখন ওরা মারুফের দেওয়া বোনের আদর মাথা পেতে নেয়।
ফাতেমা বানু দেখতে পায়, ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেও বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায়। সামনের ধানখেতের ওপর দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে। কোথাও ছোট ঘরের চাল আছে, কোথাও কৃষকের ধানখেতে কাজ আছে, দূরে উড়ে যাওয়া পাখি আছে, মেঠোপথের দুধারে তালগাছের সারি আছে। এত কিছুর মধ্যে কি যুদ্ধের ছবি আছে? ফাতেমা বানু নিজেকে প্রশ্ন করে। পরক্ষণে নিজেই উত্তর দেয়, আছে, আছে। থাকতেই হবে, নইলে দেশ স্বাধীন হবে কীভাবে? বঙ্গবন্ধু বলেছেন না ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে। এখন এই গ্রামটা একটা দুর্গ। অনেক বড় দুর্গ। ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা আছে। মারুফ বলে, আমাদের এলাকার কাদাপানি, খাল ডিঙিয়ে পাকিস্তানি আর্মি আসতে পারবে না। ওদের গাড়ি চলবে না এখানে। আমরা যুদ্ধ করতে যাব মা, কিন্তু আমরা এখন এখানে স্বাধীন।
এমন স্মৃতির মাঝে ফাতেমার হাসিমুখ ঝকমক করে। নিজেকে বলে, এটা যুদ্ধের পরের ছবি। আমাদের স্বাধীনতার ছবি।
জোরে জোরে হাসি ছড়ায় চারদিকে।
পেছন থেকে এগিয়ে আসা দুজন কৃষক পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, হাসেন ক্যান বুয়া? কার জন্য খাড়ায়ে আছেন?
মারুফের জন্য।
ওই তো দেখা যায় ওরে।
ও ওর বাপের জন্য দাঁড়ায়ে আছে।
আচ্ছা আমরা যাই।
কোথায় যাবেন?
বাজারে। ওখানে গেলে লোকের মুখে যুদ্ধের খবরাখবর পাই। রেডিও শুনি। আপনের ছেলের কি কলেজ বন্ধ?
বন্ধ না। কলেজ খোলা।
তাইলে কলেজে যায় নাই ক্যান?
কী জানি। ও জানে।
আপনে শাসন করবেন না?
বাড়িতে আসুক। জিজ্ঞেস করব যায় নাই ক্যান।
গেলাম গো বুয়া।
দুজনে এগিয়ে যায়। ফাতেমা বানু দুজন মানুষের হেঁটে যাওয়া দেখে চারদিকে তাকায়। ভাবে, এটাই আমার দুনিয়া।
বড় দুনিয়া দেখি নাই। শহরেও কোনো দিন যাই নাই। ওতে আমার কী আর যায় আসে। আমার দুনিয়া নিয়ে আমি ভালো আছি।
তুই খুব সুখী মানুষ, না রে?
হ্যাঁ, আমার সুখের শেষ নাই।
নিজেকে দেওয়া উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি শোনা যায়। সুফিয়া দেখতে পায় মারুফ আর ওর বাবাকে। সঙ্গে আছে নাটু আর বটু। ওরা এদিক-ওদিক ছোটোছুটি করছে। বুনো ফুল ছিঁড়ছে। ফড়িং দেখছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগে ফাতেমা বানুর। পরক্ষণে মনে হয়, সবাই এসে ভাত চাইবে। দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে ফিরে আসে। চুলায় আগুন নেই। নিবুনিবু হয়ে গেছে কয়লা। ফাতেমা বানু রান্নাঘরের হাঁড়িকুড়ি এক কোনায় গুছিয়ে মেঝেতে পিঁড়ি সাজায়। ভাতের থালা ধুয়ে নেয়। কলসি থেকে পানি ঢালে গ্লাসে। মাঝেমধ্যে মারুফ কলাপাতা কেটে নিয়ে এসে বলে, মা আজকে পিকনিক। আমরা কলাপাতায় ভাত খাব।
মারুফ থালা সরিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে দিলে ফাতেমা বানু বলত, কলাপাতায় ভাত খেলে পানি খাবি কিসে?
কচুপাতায়। কচুপাতাকে গ্লাস বানাব।
পানি তো পড়ে যাবে?
পড়বে না। দেখেন কেমন করে বানাই।
মারুফ পাতা মুড়িয়ে সুচালো করে দিত। ওর আব্বা এক চুমুকে শেষ করে ফেলত সেই পানি। ফাতেমা বানু নিজেও পিয়াস মেটাত। আর খুশি হয়ে বলত, তুই যে কত কিছু বুঝিস, বাজান।
এগুলো আমার আনন্দ মা। সেই সঙ্গে আপনাদেরকেও আনন্দ দেওয়া।
জীবনের কতগুলো বছর এই গাঁয়ে নিরিবিলি পার হয়ে গেল। শুধু কষ্টের জায়গা দুই মেয়ের মৃত্যু। এ কথা মনে হতেই চোখের পানি মোছে ফাতেমা বানু। সেই সঙ্গে বাবা-ছেলের কথা শুনতে পায় উঠোনে। ওরা এসে গেছে।
কই গো তুমি? ও মারুফের মা?
ফাতেমা বানু চোখ মুছে দরজায় দাঁড়ায়।
ভাত বাড়ছি।
যাই, পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসি। খুব খিদা...
আমার মিনু–বিনু কই?
ওরা ওদের ঘরে গেছে মা গো। ওদের মা ওদেরকে নিয়ে গেছে।
ফাতেমা বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বাজান আয়।
আমিও হাতমুখ ধুয়ে আসি।
ফাতেমা বানু ঘরে ঢুকে পিঁড়িতে বসে। গরম ভাত থালায় বাড়লে দেখতে পায় ধোঁয়া উঠছে। তিনজনের জন্যই থালা ভরে ভাত বেড়ে তাকিয়ে থাকে ধোঁয়ার দিকে। আজ এটাও তার কাছে যুদ্ধের ছবি। পরক্ষণে নিজেকে বলে, এমন করে যুদ্ধের ছবি দেখায় ওর জীবনের পথঘাট বদলে গেছে। ওর মাথায় নিজের জন্য কোনো চিন্তা নাই। ওর সামনে এখন একটাই ছবি। বকুলগাঁয়ে বড় হয়ে ওঠা ফাতেমা বানুর সামনে বকুলগাঁই স্বপ্নের দেশ। ও কোনো দিন শহরে যায়নি। এ গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়েছে। এভাবেই ওর দেশ দেখা। দেশের শহরের কথা, অন্য জেলার কথা শুনেছে মানুষের মুখে। সেই থেকে ছবি দেখার ধারণা হয়েছে নিজের মনে। অনেক সময় চোখ বুজে থেকে দেশের নানা জায়গার ছবি ভাবতে শিখেছে। এভাবে দেশের ভাবনা ওর হৃদয়জুড়ে আছে। এই সময়ে যুদ্ধের ছবি দেখা তার রাত–দিনের নিয়ম হয়েছে।
এই দেশ স্বাধীন হবে একদিন। এই কাদাভরা মাঠঘাট, পথ-প্রান্তর, নদী-খাল-বিল ওর সামনে।
মা গো ভাত দেন।
মারুফ রান্নাঘরে ঢুকে পিঁড়ি টেনে বসে। পেছনে তোরাব আলী ঢোকে। তিনজনে বসে পুঁটি মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খায়। সঙ্গে বেগুনের ভর্তা আর ডাল আছে। মারুফ গবগবিয়ে কয়েক মুঠো ভাত খেয়ে বলে, আবার কবে মায়ের রান্না করা ভাত খাব, কে জানে।
ফাতেমা বানু সরাসরি ওর দিকে তাকায়। ও মাথা নিচু করে ভাতে তরকারি মাখাচ্ছে। তোরাব আলী ধমকের সুরে বলে, এমন কথা বলবি না।
কেউ কোনো কথা বলে না। মারুফ কথাটা কেন বলেছে, ফাতেমা বানু তা বুঝে যায়। সে জন্য নিজেও কথা বলে না। তোরাব আলীর ধমক মনে রাখে মাত্র। মারুফ বাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমি কাল সকালে যুদ্ধ করতে যাব। দীনেশ, বাদল, রহিম নৌকা নিয়ে আসবে। আমরা চারজন একসঙ্গে যাব।
ও আচ্ছা।
তোরাব আলী থালার ভাত শেষ করে নিঃশব্দে উঠে যায়। দুজনেই তাকিয়ে দেখে, তোরাব আলী পুকুরের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
মা গো, আমি এখনই চলে যাব ওদের সবার সঙ্গে কথা বলতে। আব্বাকে কিছু বলার দরকার নেই।
ফাতেমা বানু ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মুখে কিছু বলে না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় যুদ্ধের ছবি। কুড়ি বছর ধরে দেখা চেনা মুখটা বদলে যায়। ওটা এখন তার সামনে রণক্ষেত্র।
পরদিন সকালবেলা। তখনো সূর্য ওঠেনি। ভোরের¯স্নিগ্ধ আলো বিছিয়ে আছে চারদিকে। তিনজনে খালপাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তোরাব আলী ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে, দোয়া করি তোকে। দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবি। মায়ের হাতের রান্না ভাত খাবি।
হা হা করে হাসে মারুফ। হাসতে হাসতে মা–বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। ফাতেমা বানু ছেলের কপালে চুমু দেয়। দেখতে পায় নৌকা আসছে। ওরা তিন বন্ধু হাত নাড়াচ্ছে।
একসময় নৌকা এসে থামে। উঠে যায় মারুফ। ফাতেমা বানু বলে, নৌকাটা যতক্ষণ দেখা যাবে, আমি ততক্ষণ এখানে বসে থাকব।
থাকো। আমি ঘরে যাই।
কতকাল ধরে চেনা এই খাল আজকে ওর সামনে যুদ্ধের ছবি। কলকল করে বয়ে যাওয়া খালের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি অন্য কোনো দিকে ঘোরে না। দেখতে পায় না যে বটু–নাটু দৌড়ে আসছে। ওরা কাছে এসে পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, ভাইয়া কোথায় গেল নৌকায় করে? আমাদের দেখে হাত নাড়িয়েছে। কথা বলেনি।
তোদের ভাইয়া যুদ্ধ করতে গেছে রে বিনু–মিনু।
যুদ্ধ, যুদ্ধ। আমরাও যাব যুদ্ধ করতে। ভাইয়া আমাদেরকে নিয়ে যায়নি কেন? ওরা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বারবার বলে, আমরাও যুদ্ধ করব।
ফাতেমা বানু ওদের বুকে জড়িয়ে ধরে খালের দিকে তাকালে দেখতে পায়, নৌকা চলে গেছে। খালের পানিতে কলকল করছে বটু–নাটুর কথা, আমরাও যুদ্ধ করব, আমরাও যুদ্ধ করব।