তিন প্রেমিকার চোখে মায়াকোভ্স্কি
আলোচ্য বইয়ের মূল অংশে যাওয়ার আগে পাঠককে বিনয়ের সঙ্গে পাঠ করতে বলব এর ভূমিকা। কোনো বইয়ের ভূমিকা যদি প্রকৃত অর্থেই ভূমিকা হয়ে ওঠে, তাহলে তার পাঠ মূল বইয়ের পাঠকে নিবিড়ভাবে সাহায্য করে। মূল রুশ ভাষা থেকে জাহীদ রেজা নূরের অনুবাদে প্রকাশিত তিন প্রেমিকার মায়াকোভ্স্কি গ্রন্থের ভূমিকা ঠিক সেই পঙ্ক্তিভুক্ত।
ভূমিকা মারফত জাহীদ আমাদের জানান, ‘রুশ ভাষায় ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভ্স্কিকে নিয়ে অসংখ্য স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে। তাঁর অদ্ভুত বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে সেসব স্মৃতিচারণায়। এর মধ্যে এমন একটি বই বেরিয়েছে ১৯৯৩ সালে, যেটিতে আটজন বন্ধু ও নারী বলেছেন মায়াকোভ্স্কিকে নিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অবিশ্বাস্য ভালোবাসার কথা। সেসব লেখায় রয়েছে এমন সব ঘটনা, যা কেবল নারীর চোখই আবিষ্কার করতে পারে।’ একই কথা বলেছেন মায়াকোভ্স্কির একমাত্র সন্তান—কন্যা ইয়েলেনা ভ্লাদিমিরোভ্না।
আমার ধারণা, ঠিক এই বিবেচনা থেকেই সম্ভবত এই বইয়ে বেছে নেওয়া হয়েছে তেমন তিন নারীকে, যাঁরা মায়াকোভ্স্কির জীবনের নানা পর্বে তাঁর ওতপ্রোত সহচারিণী ছিলেন। এই তিন নারী হলেন—এলসা ত্রিয়োলে, লিলিয়া ব্রিক ও ভেরোনিকা পোলান্স্কায়া। প্রত্যেকেই স্মৃতিচারণা সূত্রে তুলে ধরেছেন এই মহান রুশ কবি, কিউচারিস্ট কাব্য আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য উদ্যোক্তা ও নাট্যকারের জীবনকথা।
এলসা ত্রিয়োলের লেখার শিরোনাম ‘ফিরে দেখা অতীত’, লিলিয়া ব্রিকের ‘স্মৃতিকথা থেকে’ এবং ভেরোনিকা পোলান্স্কয়ার ‘শেষ বছর’। আর পরিশিষ্টে আছে ‘মায়াকোভ্স্কির মেয়ে বলছে’ শিরোনামে তাঁর মেয়ে ইয়েলেনা ভ্লাদিমিরোভ্নার সাক্ষাৎকার, কবির জীবনপঞ্জি ও ব্যক্তি পরিচিতি।
এলসা ত্রিয়োলে বলেছেন, ১৬ বছর বয়সে তাঁর মায়াকোভ্স্কির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, প্রেমে পড়া এবং তাঁর কবিতার অনুরক্ত-অনুগ্রাহী হওয়ার কথা। নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা। শেষে লিখেছেন, ‘মায়াকোভ্স্কি এক নারীর কাছ থেকে অন্য নারীর দিকে হেঁটেছে, ক্ষুধার্ত ও কৃপণের মতো, খুব বেশি মন খারাপ করে থেকেছে...তারাই ছিল ওর জীবনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়, তারপরও সে চাইত একটি সত্যিকারের একমাত্র ভালোবাসার সন্ধান। লিলিয়াকেই শুধু ভালোবেসেছে, কিন্তু একই সঙ্গে অন্য নারীর প্রতিও আসক্ত হয়েছে। ওর চরিত্রটাই ছিল এমন।’
প্রেম-ভালোবাসা, কাব্য রচনা, কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে নানা সংগঠন গড়ে তোলার পরও, মায়াকোভ্স্কি পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। ফলে অবহেলা আর লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। এসবই তাঁকে পীড়িত করেছে। ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে এসব তথ্য।
>
তিন প্রেমিকার মায়াকোভ্স্কি
সংকলন ও রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
২৫৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৫০০ টাকা।
তবে যাঁদের প্রেমে তিনি পড়েছেন, কিংবা যেসব নারী তাঁর প্রেমে পড়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ তেমন প্রকট নয়। ঈর্ষাকাতর হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই অভিমান করেছেন, কিন্তু মায়াকোভ্স্কিকে তাঁরা ছোট করে দেখেননি।
বিয়ে না করেও যাঁর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল, এমনকি স্বামী থাকা সত্ত্বেও দৈহিক সম্পর্কও, সেই লিলিয়া ব্রিকের স্মৃতিসূত্রে শোনা যাক তাঁদের মধ্যকার টানাপোড়েনের কথা। লিলিয়া ব্রিক তাঁর ‘স্মৃতিকথা থেকে’ জানাচ্ছেন, ‘মায়াকোভ্স্কির জীবনে ভালোবাসা, ঈর্ষা, বন্ধুত্ব—সবই ছিল বিশাল মাপের। সাধরণ মানুষ তা ছুঁতে পারবে না। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে ও কথা বলতে একেবারেই পছন্দ করত না। সে ক্রমাগত কবিতা লিখে চলত আর কবিতার মধ্যেই নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করত।’ অস্তিমে লিলিয়া বলেছেন, ‘ভলোদিয়ার (মায়াকোভ্স্কি) মৃত্যুর পর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ‘‘লিলিয়া-ভালোবেসো আমাকে।” আমি ওকে ভালোবাসি। প্রতিদিন ও কবিতায় আমার সঙ্গে কথা বলে।’
মায়াকোভ্স্কির ‘শেষ বছর’-এর কথা বলেছেন তাঁর প্রেমিকা ভেরোনিকা পোলান্স্কায়া। দৈনন্দিন নানা চমৎকার সব ঘটনার পাশাপাশি তাঁর সরল জীবনযাপনের কথাও নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন তিনি। ভেরোনিকার স্বামী ছিল। তারপরও তিনি অকপটে জানাচ্ছেন, ‘আমি মায়াকোভ্স্কিকে ভালোবেসেছিলাম। সে আমাকে ভালোবেসেছিল।’
পরিশিষ্টে ‘মায়াকোভ্স্কির মেয়ে বলছি’ শিরোনামের সাক্ষাৎকারে মেয়ে ইয়েলেনা ভ্লাদিমিরোভ্না জানাচ্ছেন, ‘সত্যি বলতে কি, আমি এখনো বাবার কথা মনে করি, তিনি না থাকার কষ্ট পাই। আমার মনে হয়, বাবা যদি এখন আমাকে দেখতেন, আমার এখনকার জীবন সম্পর্কে জানতেন, তাহলে তাঁর ভালো লাগত।’
‘মায়াকোভ্স্কির মেয়ে বলছি’ সাক্ষাৎকারটি যাঁরা পড়বেন, আমি নিশ্চিত, তাঁদের চোখ অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারবে না।
জাহীদ রেজা নূরকে অভিনন্দন মহান এই রুশ কবিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁর অনুবাদ ঝরঝরে। বইটি পড়তে
বসলে বিরতি ছাড়াই শেষ না করে পারা যাবে না।