প্রত্যয়ী স্মৃতির লেখাগুচ্ছ

আবুল হাসনাতের কবিতা ও গদ্যকৃতি আড়াল হয়ে গেছে তাঁর সাহিত্য সম্পাদনার কৃতিতে। সেই সংবাদ যুগ থেকে আজকের কালি ও কলম পর্যন্ত সাহিত্য সাময়িকী ও সাহিত্যপত্র সম্পাদনায় তাঁর সাফল্যের কথা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য, জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য শীর্ষক প্রবন্ধ গ্রন্থ দুটি তাঁর অভিনতুন গদ্যসত্তার সবল সাক্ষ্যবহ।
‘ভূমিকা নয়’ শীর্ষক বিনয়ী-বচনে বলছেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে সম্পাদনা কাজে যুক্ত থাকবার ফলে নিজের লেখালেখি অব্যাহত রাখা ছিল কষ্টকর। যদিও বিভিন্ন সময়ে লিখেছি কোনো না কোনো জিজ্ঞাসা নিয়ে—প্রবন্ধ, স্মৃতি বা কখনো চিত্রকলা বিষয়ে প্রত্যক্ষণের সমীক্ষা ও কবিতা। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে কত বিষয়ে যে জিজ্ঞাসা জাগে এ-বলে শেষ করা যায় না।’
বলার কথা হলো, এতকাল সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেও আবুল হাসনাতের গদ্যভূমি মোটেও ম্লান হয়নি, বরং তাঁর নিজস্বতার মুদ্রাময় গদ্যভঙ্গির গুণে বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধগুচ্ছ পাঠককে দীপিত করে অনায়াসেই। এই বইয়ে তাঁর আলোচ্যজনেরা যথাক্রমে—শম্ভু মিত্র, অশোক মিত্র, রেহমান সোবহান, খালেদ চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, আহমদ রফিক, সন্‌জীদা খাতুন, সমর সেন, হামদি বে, দ্বিজেন শর্মা, ভূমেন্দ্র গুহ, মাহমুদুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, মতিউর রহমান, মন্দিরা নন্দী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, সুবীর চৌধুরী ও বুলবুল চৌধুরী।

>

প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য
আবুল হাসনাত
প্রচ্ছদ: কামরুল হাসানের শিল্পকর্ম অবলম্বনে তারিক সুজাত
প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা প্রকাশকাল: মে ২০০৯
২৫২ পৃষ্ঠা, দাম: ৬০০ টাকা।

সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি—ইত্যাদি ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রজন্মের বিচিত্র গুণীগণ এসেছেন হাসনাতের গদ্যের আলোছায়ায়। এ বই এভাবে এক পরম্পরার গ্রন্থ, যেখানে সেকালের শম্ভু মিত্রের চেতনাঢেউ এসে মেশে এ কালের সন্‌জীদা খাতুনের সৃজনসৈকতে। সৃষ্টির আলোপ্রভ মানুষের জীবনবৃত্তান্ত দাখিল এবং তার সঙ্গে স্মৃতিসংযোগ বয়ানে দায় সারেননি লেখক, বরং কৃতীজীবনের অনুন্মোচিত অধ্যায়ে আলো ফেলে, পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে তাকে বুঝে নিতে চেয়েছেন। যেমন, শম্ভু মিত্র প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বহুরূপীর অভ্যন্তরীণ সংকট ও সমকালীনদের তাঁকে এড়িয়ে চলা তাঁকে যে বেদনা দিয়েছিল, সে জন্যই বোধকরি মৃত্যুর কিছুদিন আগে রচিত ক্ষুদ্র একটি ইচ্ছাপত্রে শম্ভুর অভিমান, ক্ষোভ ও বিপন্নতা উন্মোচিত হয়েছে। শম্ভু মিত্র অন্তিম জীবনে সমাজ, রাষ্ট্র, সহযাত্রী ও আত্মজনকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানে বুঝতে চাইতেন, এই ইচ্ছাপত্র যেন তারই নিদর্শন হয়ে থাকল। এ শুধু প্রামাণিক দলিল নয়, এ ইচ্ছাপত্রে আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাঁর জীবনদর্শনেরও অনুষঙ্গ।’
অশোক মিত্র ও রেহমান সোবহান নামী অর্থনীতিবিদ, একই সঙ্গে তাঁরা উজানবাদী সংস্কৃতির মানুষ; তাঁদের উভয়কেই হাসনাত বিশ্লেষণ করেন জীবনের সেই বৃহৎ প্রেক্ষণীতে, যেখানে মানুষের প্রতি অঙ্গীকারে তাঁরা এক হয়ে যান। খালেদ চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে জানাতে ভোলেন না কামরুল হাসানের চিত্রকাজে মর্মরিত হয়ে উঠেছিল খালেদের কলকাতার বাসগৃহ। মাহমুদুল হক ও হাসান আজিজুল হকের কথাভুবন নিয়ে কথামালা প্রমাণ করে কথাশিল্প পর্যালোচনায় তাঁর সম্পন্নতা। সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শামসুর রাহমানের কবিতাভুবন নিয়ে সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণ বিশিষ্টতার দাবি রাখে। কবিতা অনুধাবনে যে মর্মজ্ঞান সবচেয়ে জরুরি তার দেখা পাওয়া যাবে হাসনাতের মেধাবী ও সশ্রম কবিতালোচনায়।
আবার সন্‌জীদা খাতুন ও সৈয়দ হাসান ইমামকে নিয়ে যখন লেখেন, তখন সংগীত ও নাটক—লেখার কেন্দ্রভাগে থাকে বটে, তবে তাঁদের সামগ্রিক সংস্কৃতিসাধনার স্বরূপই সেখানে প্রধান হয়ে ধরা দেয়। যেমনটি নৃত্যঝংকারের বুলবুল চৌধুরী, বৃক্ষসখিতার দ্বিজেন শর্মা, জীবনানন্দ চর্চার ভূমেন্দ্র গুহ, বুদ্ধিবৃত্তিকতার আহমদ রফিক, সাংবাদিকতার হামদি বে, চিত্রকলা আন্দোলনের সুবীর চৌধুরী—এঁদের প্রত্যেককে নিয়ে লিখিত গদ্যগুলোতেও সমান প্রতিভাত। মন্দিরা নন্দী তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর ভিন্নতর গদ্যগ্রন্থ আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা-গান-শিল্পের ঝরনাধারায়—বই দুটির সূত্রে আলোচনায় এসেছেন, কিন্তু বই আলোচনার বৃত্ত ভেদ করে তাঁরা হয়ে উঠেছেন লেখকের মুক্তরচনার মহার্ঘ্য বিষয়।
প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য এভাবে খুলে দেয় স্মৃতির দখিন দুয়ার, সত্তার মৃত্তিকায় সঞ্চার করে জ্ঞান ও সংস্কৃতিঋদ্ধ আশাবাদী আগামীর পলি আর আমাদের অপেক্ষায় রাখে আবুল হাসনাতের নতুনতর স্মৃতিগ্রন্থের।