নজরুলের সাম্যবাদ কেমন? অতি বিখ্যাত ‘মানুষ’ কবিতায় মানুষকে কীভাবে হাজির করেছেন তিনি? তাঁর জয়ন্তী উপলক্ষে ফিরে দেখা
শিরোনামের ‘মানুষ’ কথাটিকে আমরা মানুষ সম্পর্কে নজরুলের সার্বিক ধারণা হিসেবে দেখতে পারি, আবার সাম্যবাদী কাব্যের অতি বিখ্যাত কবিতা হিসেবেও পড়তে পারি। এ লেখায় আমরা দুই অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করব, যদিও আমাদের লক্ষ্য থাকবে বিশেষ কবিতাটি; আমরা সার্বিক থেকে যাব বিশেষের দিকে, এ কথা বলতে যে নজরুলকে যদি মানবতাবাদী হিসেবেই পেতে হয়, তাহলে তা পাওয়া যাবে বিশেষ পাঠে, কোনো সার্বিক অভিধায় বা নামায়নে নয়। আমাদের এ কথার পেছনে আছে বাংলাভাষী অঞ্চলে নজরুলকে হরেদরে মানবতাবাদী হিসেবে পাঠের রেওয়াজ, যেখানে মানবতাবাদী কথাটার যে অসংখ্য ব্যঞ্জনা আছে, সে কথা মনে না রেখেই অভিধাটি ব্যবহৃত হয়। মিশেল ফুকো পশ্চিমা ইতিহাসের আধুনিক পর্বে ধারণাটির ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন তাঁর ‘হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট’ (১৯৮৪) নামের বিখ্যাত প্রবন্ধে। বলেছেন, ইতিহাসের এত বিচিত্র ও বিপরীতমুখী দল নিজেদের পরিচয় হিসেবে মানবতাবাদী কথাটা ব্যবহার করেছে যে কোনো বিশেষ অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে তা দাগিয়ে না দিলে কথাটার আসলে কোনো অর্থ হয় না। এ কথা নজরুলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
দুনিয়ার বিচিত্র প্রান্তে মানবতাবাদ কথাটি সবচেয়ে প্রভাবশালী যে অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তার উৎস ইউরোপীয় রেনেসাঁস থেকে আলোকায়নপর্ব হয়ে উনিশ শতকীয় উদারনীতিবাদ। ঔপনিবেশিক শাসনের কল্যাণে এ ধারণা বাংলাভাষী অঞ্চলেও প্রতাপশালী হয়েছিল। স্থানীয় চর্চাকারীরা অবশ্য খুব একটা মনে রাখেননি যে ওই ধারণাটি একান্তই ইউরোপীয়, জন্মেছে ইউরোপের বিশেষ বাস্তবতায়, আর ধারণাটি গভীরভাবে শর্তযুক্ত। কেবল শর্তপূরণ সাপেক্ষেই কেউ একজন ওই ধারণা মোতাবেক মানুষের মর্যাদা পেতে পারে। বস্তুত, ইউরোপীয়রা কলোনিতে যে ‘অমানবিক’ শাসন চালিয়েছিল, তাতে ইউরোপীয় বিশ্রুত মানবতাবাদীরা খুব একটা গা করেননি প্রধানত এই ধারণায় যে স্থানীয়রা যথেষ্ট ‘মানুষ’ নয়, আর তাদের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার জন্য পশ্চিমের ঔপনিবেশিক শাসন জরুরি। নজরুল যে এ স্কুলের মানবতাবাদ খরিদ করেননি এমন নয়। কিন্তু তাঁকে এ অর্থে মানবতাবাদী বলার বিপদ সম্পর্কে একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। নজরুল ঘোষিতভাবে বিপ্লবী। রক্তপাতে তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই। তাঁর কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একাংশ কাব্যিক অর্থে এবং বিষয়ের দিক থেকে বিপ্লবের পৃষ্ঠপোষকতা করে। অথচ উদারনীতিবাদী স্কুল বস্তুত বিপ্লববিরোধী। নজরুলের ভাষায়, তারা রেভল্যুশন নয়, পছন্দ করে ইভল্যুশন। তা ছাড়া নজরুল মানুষের মধ্যে গরিব মানুষের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর ‘মানুষ’ ধারণাটি নিপীড়িত মানুষকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে। ধারণাটি তাঁর কাছে কাজের দিক থেকে জরুরি গণ্য হয়েছিল সেকালের আরেক বাস্তবতা থেকে। তখন হিন্দু-মুসলমান বিরোধ প্রায়ই দাঙ্গার রূপ নিচ্ছিল। দুই সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো সমাজের আর রাজনৈতিক অঙ্গনের সম্ভাব্য স্থিতি বিনষ্ট করছিল। এই প্রেক্ষাপটেই ‘মানুষ’ কবিতাটি লেখা। এই বাস্তবতার মধ্যেই নজরুল মানুষকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন, তার রূপ-স্বরূপ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।
কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে আছে সাম্যের ঘোষণা, দ্বিতীয় পঙ্ক্তি ঘোষণা করছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। এই শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে তৃতীয় চরণ দেশ-কাল-ধর্মের বিভিন্নতা মানুষের মর্যাদায় হেরফের ঘটাতে পারে না ওই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই। প্রথম পঙ্ক্তির ঘোষণা অনুযায়ী আমরা নজরুলকে সাম্যবাদী বলতে পারি। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এই সাম্যবাদ কিছুতেই মার্ক্সবাদী সাম্য নয়। উৎপাদন ও বণ্টনের নিরিখে মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো ইশারা অন্তত এ কবিতায় নেই। আছে বরং বিপরীত ধারণা উৎপাদনে অংশ নেওয়ার অধিকার না থাকা এবং বণ্টনবিধিতে অপাঙ্ক্তেয় হওয়া সত্ত্বেও কেবল মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার সুবাদেই কেউ একজন উত্তুঙ্গ মানব মহিমায় আসীন। যথেষ্ট ঝোঁক এবং মিল থাকার পরও এ অবস্থানকে ইউটোপীয় সাম্যবাদও বলা যায় না, কারণ, ধর্ম ও জাতিগত বিবাদ-বিসংবাদের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যেই প্রস্তাবটি কাজ করছে। প্রথম চার পঙ্ক্তিকে একত্রে বলতে পারি কবিতাটির মূল প্রস্তাব। এই প্রস্তাব নিজেই নিজের ঘোষণায় চূড়ান্ত; কোনো পূর্বসূত্র বা যুক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। এমনকি পরেও এ প্রস্তাবের পক্ষে কোনো যুক্তি তৈরির চেষ্টা করা হয়নি। তবে ব্যবহৃত উদাহরণগুলো একদিকে প্রস্তাবটির যথার্থতা নির্দেশ করে, অন্যদিকে বিরোধীদের নির্মমভাবে শায়েস্তা করে।
মূল প্রস্তাবের পরপরই নজরুল হাজির করেন প্রস্তাবের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ, যথাক্রমে মন্দিরের ‘পূজারি’ ও মসজিদের ‘মোল্লা’কে। দুই বাদীর অবশ্য ধর্ম-পরিচয় মুখ্য নয়, দুজনই ‘ভুখারী’—ক্ষুধার্ত। মন্দির ও মসজিদকে নাটমঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে এই বাদী-বিবাদীর যে রঙ্গ নজরুল কবিতার বেশে মঞ্চস্থ করেছেন তা অসাধারণ। সংলাপময়তা, শ্লেষ, আহাজারি এবং এসবের মধ্যেই ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের নিখুঁত চাল কবিতাংশ দুটিকে কাব্যিক অর্থেই মহিমান্বিত করেছে। এ অংশের পাঠকপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, নজরুল প্রধান আসামি হিসেবে এ দুই গোত্রকেই সাব্যস্ত করলেন কেন? যদি ক্ষুধায় পীড়িত মানুষের মধ্যে কবি তাঁর ঘোষিত ‘মানুষ’ ধারণার সর্বাধিক বিলয় প্রত্যক্ষ করেও থাকেন, তবু এ কথা বলা সংগত হবে না যে মন্দির-মসজিদের মানুষগুলো তার জন্য দায়ী। বস্তুত মন্দির-মসজিদের পুরুত-মোল্লারা জগতের সম্পদের অনুল্লেখ্য অংশই নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই ভুখা মানুষের দীর্ঘ মিছিলের দায়ভার তাদের ওপর চাপানো যায় না। তা ছাড়া, ‘মানুষ’ নামের কোনো সার্বিক বর্গ যদি নজরুল প্রতিষ্ঠা করতেই চান, সেই বর্গে এমনকি মোল্লা-পুরুতদেরও ঠাঁই হওয়া চাই। এতসব ঝুঁকি নিয়ে নজরুল যে মোল্লা-পুরুতকেই সামনে নিয়ে এলেন তাতেই মনে হয়, দেশ-কালের বাস্তবতা তাঁকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সেই বিশ শতকের বিশের দশকের কলকাতা, বাংলা অঞ্চল ও ভারতের বাস্তবতা, যখন হিন্দু-মুসলমান জাতীয়তাবাদী ঐক্য ভেঙে পড়েছিল, আর বাড়ছিল সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গা। ফলে বড় হয়ে উঠেছিল হিন্দু, মুসলমান, মন্দির, মসজিদ, পুরুত, মোল্লা প্রভৃতি বর্গ। এসব অব্যবহিত উপাদানের বাধা পেরিয়ে মানুষের মাহাত্ম্য ঘোষণার একটা ডিসকোর্স তখন বেশ প্রতাপশালী ছিল। আর নজরুল ‘মানুষ’ কবিতায় সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। কবিতার বাকি অংশের অন্তর্লীন গড়ন পরীক্ষা করলেও আমরা দেখব, হিন্দু ও মুসলমান বর্গের সাম্য, সাযুজ্য ও সহাবস্থান পুরো কবিতার গঠনগত ভিত্তি।
এ কবিতায় পুরুত-মোল্লার বাইরে বিবাদী আরও আছে। কবিতার শেষ কয়েক পঙ্ক্তিতে আছে তার পরিচয়। সেখানে সম্পদশালীদের ওই অংশের কথা আছে, যাঁরা সম্পদের প্রাসাদ গড়েছে গরিবের রক্ত পান করে। কবি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন, অন্যায্য কামনাই তাঁদের ধ্বংসের কারণ হবে। বাদী কিন্তু একজনই জগতের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত। কবি তাঁর পক্ষেই ওকালতি করেছেন। এই ওকালতি শর্তহীন নয়। দুই ধাপে তিনি তাঁর ওকালতির পক্ষে যুক্তি তৈরি করেছেন। এক দফায় নবীদের এবং ভারতীয় ধর্মপ্রচারকদের অভিহিত করেছেন ‘বিশ্বের সম্পদ’ হিসেবে; আর মানুষকে বলেছেন তাঁদের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকার একদিকে রক্তের, অন্যদিকে দৈহিক-মানসিক সাযুজ্যের। এই সাযুজ্যই প্রমাণ করে, সবচেয়ে নিগৃহীত মানুষটির মধ্যেও সেই গুণ আছে, যে গুণের পরিণতিতে নিতান্ত অভাজনও দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় দফায় তিনি আরও কিছু নাম নেন। হিন্দু পুরাণে কথিত কল্কি অবতার এবং ইসলামি কাহিনিতে বর্ণিত ‘মেহেদী’ ও ‘ঈসা’র নাম নিয়ে সাবধান করে দেন, যাকে মানুষ নামের আসন দিতে দ্বিধা করা হচ্ছে, তার মধ্যেই হয়তো বেনামিতে কলিযুগ বা শেষ জমানার উদ্ধারকর্তারা বিদ্যমান আছেন।
এ পর্যন্ত যা বলা হলো, তা থেকে কবিতাটির অন্তত তিনটি দিক বিশেষভাবে আমাদের নজর কাড়ে।
এক. হিন্দু এবং মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উল্লেখ এমন সমান্তরালভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে মানুষের মহিমা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এ দুই জনগোষ্ঠীর পারস্পরিকতার একটা বোধও তৈরি হয়। ধর্মপ্রচারকদের পর যৌথভাবে আসে শেষ জমানার উদ্ধারকারীর ধারণা, তারও পরে দুই ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রচারকদের রাখাল আর কৃষক হিসেবে কাজ করার দৃষ্টান্ত। পরস্পর বিরোধে লিপ্ত দুই জনগোষ্ঠীর এ রকম উপস্থাপন নিশ্চয়ই মিলনের আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ। এ আকাঙ্ক্ষার ধরন নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। মিলনের আকাঙ্ক্ষাটা কেবল দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে নয়, একই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেও ক্রিয়াশীল। তার প্রমাণ, হিন্দুধর্ম-নির্দেশক উল্লেখের পরিমাণ কবিতায় যথেষ্ট বেশি। কারণ, জাতিবিভেদের সংকট ওই সমাজেই প্রবল।
দুই. কবিতাটির উদ্দিষ্ট পাঠক নিশ্চয়ই নিরীহ ভদ্রলোকসমাজ। তারা নিপীড়িত সমাজের অংশ নয়, আবার নিপীড়কও নয়। এমন এক ভঙ্গিতে কবি তাদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন যেন তাদের অচেতন মনে চেতনার আঘাত দিতে পারলেই তা বিপুল নিপীড়িতের কল্যাণের কারণ হবে। কেবল তত্ত্ব পরিবেশনায় তাঁর আগ্রহ নেই। তিনি কাজ চান এবং যে ভদ্রলোকসমাজ বঞ্চিত মানুষদের কল্যাণের কারণ হয়ে উঠবে, তাদের মন স্পর্শ করতে চান। এ কারণেই পুরো কবিতার মধ্যে প্রকাশ্য এবং গোপন ‘ধর্মভাব’ আছে। প্রকাশ্য উল্লেখের কথা আগেই বলেছি। গোপন ধর্মভাবের একটা লক্ষণ এই যে কবিতার প্রায় সর্বাংশেই চূড়ান্ত রেফারেন্স হিসেবে স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে। কবিতায় যে আর্তিটি পুনঃপুন উল্লেখে প্রধান হয়ে ওঠে, তার মূলকথাটা দাঁড়ায় এ রকম: পীড়িতের পাশে দাঁড়ালেই কেবল স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে; কারণ, স্রষ্টা পীড়িতের বেশেই সংসারে অবস্থান করেন।
তিন. আগেই বলেছি, কবিতার প্রথম স্তবকের প্রস্তাব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা কোনো পূর্বসূত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। অথচ সেই প্রস্তাবের বিস্তার যখন এল, তখন তাতে শর্তযুক্ত হলো; এ অর্থে যে মানুষের অসীম সম্ভাবনার কারণেই তাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। কবিতার একাংশে একবারের জন্য মনে হয়েছে যেন শর্তহীন মানব মহিমা ঘোষিত হয়েছে: ‘অথবা হয়তো কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,/ আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,/ তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়/ ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সমপবিত্র নয়!’ [‘গ্রন্থ’, ‘ভজনালয়’, ‘পবিত্র’ প্রভৃতি শব্দের ধর্মভাব লক্ষণীয়।] কিন্তু না। কবি এখানে থামেননি। এগিয়েছেন আরও। বলেছেন, ওই ঘরে হয়তো জন্ম নেবে এমন কেউ, যার সমতুল্য কিছু দুনিয়া এর আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। শর্তসাপেক্ষ এই মানব মহিমা বাহ্যত পশ্চিমা উদারনীতিবাদেরই তুল্য। কিন্তু অন্তর্গত মেজাজে উল্টোটাই বেশি সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। নজরুলের শর্ত এমন নয় যে ব্যক্তিকে সক্রিয় সাধনায় কোনো কিছু অর্জন করতে হবে; বরং ব্যক্তির স্বাভাবিক অস্তিত্বের মধ্যেই আছে ওই সম্ভাবনা, যা নিজেই শর্ত পূরণ করবে।
‘মানুষ’ কবিতার উচ্চারণভঙ্গিতে প্রথানুগত্য প্রবল, যদিও খাঁটি নজরুলীয় উচ্চারণ বিরল নয়। সার্বিকভাবে কবিতাটি বিপ্লবী ঘরানার নয়। কিন্তু কবিটি নজরুল বলেই আমূল পরিবর্তনকামী যথার্থ বিপ্লবী মুহূর্তও উদ্যাপিত হয়েছে কবিতাটিতে। প্রভুর মসজিদে ও মন্দিরে স্বার্থান্ধ ভণ্ডের দলের বদলে মানুষের অধিকার কায়েমের জন্য কবি আবাহন করেছেন বিপ্লবকে। ধ্বংসের মূর্তিমান ইতিহাস হিসেবে আহ্বান জানিয়েছেন চেঙ্গিস-মামুদ-কালাপাহাড়কে; হেঁকেছেন হাতুড়ি-শাবলের হুংকার। আর এই ধ্বংসের ভাবগত সংগতি বিধান করতেই তৈরি করেছেন ‘গ্রন্থ’ ও ‘মানুষে’র দ্বৈরথ। তাতেই জন্ম নিয়েছে এক বিপ্লবী উচ্চারণ: ‘মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’ উচ্চারণ এত সরল আর সবল যে রচিত হয়ে যাওয়ার পর সে নিজের শরীর থেকে বিপ্লবের চিহ্নই মুছে ফেলে। নজরুলের ‘মানুষ’ ধারণাটি হয়তো বৈপ্লবিক নয়, কিন্তু এ রকম কিছু বৈপ্লবিক মুহূর্তই ওই ধারণাটিকে বিশিষ্ট করে তোলে।
এভাবে গড়ে ওঠে নজরুলের ‘মানুষ’। লালন প্রমুখ কবির রচনায় শর্তহীন মানব মহিমা প্রচারের যে স্বাভাবিকতা দেখি, নজরুল পুরোপুরি তার সমরূপ নন। সম্ভবত ভদ্রলোকদের কবির পক্ষে তা সম্ভবও নয়। তবে প্রভাবশালী মানবতাবাদী ধারণা থেকেও নজরুল নিজেকে আলাদা করে নেন। তাতে যোগ করেন বিপ্লবী জোশ; নিয়ে আসেন বাস্তবের প্রচণ্ড প্রণোদনা। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রচণ্ডতায় তাঁর ‘মানুষ’ সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা পায়। কিন্তু রূপ ও ধরন যা–ই হোক, নজরুল ‘মানবকেন্দ্রিক’ই বটে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘মানুষে’র ধারণা যেভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, আর আরও পরে প্রধানত প্রকৃতিকেন্দ্রিকতার জমানায় ‘মানবকেন্দ্রিকতা’র যেভাবে বিলয় ঘোষিত হয়েছে, সেদিক থেকে দেখলে নজরুলকে সাধারণভাবে মানবতাবাদী বলাই যায়। এ অভিধা হয়তো সবকিছুই নির্দেশ করে; এবং সে কারণেই, বিশেষভাবে কোনো কিছুই নির্দেশ করে না।