বদলে যাচ্ছে আমেরিকা

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

দৌড় প্রতিযোগিতায় ‘রেডি’ বলার আগে দৌড় শুরু করাকে বলা হয় ‘ফলস স্টার্ট’। যুক্তরাষ্ট্রে আইন ও বিচারব্যবস্থার, বিশেষ করে অশ্বেতকায়দের হাতে পুলিশের অযথা শক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সংস্কারের উদ্যোগ অনেকবারই নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার সব কয়টিই ‘ফলস স্টার্টে’ পরিণত হয়েছে। গত মাসে মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে ৪৮ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর দেশব্যাপী যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা–ও যে মরীচিকায় পর্যবসিত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এবার হয়তো পরিবর্তন আসবে।

ইতিমধ্যেই সেই পরিবর্তনের কিছু কিছু প্রমাণ মিলেছে। দেশের একাধিক পুলিশ বিভাগে শক্তি প্রয়োগ ও পুলিশের গৃহীত ব্যবস্থার জবাবদিহির প্রশ্নে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘোষিত হয়েছে। মিনিয়াপোলিস, ফ্লোরিডা, টেক্সাস ও নিউইয়র্কে অপরাধী সন্দেহে কারও গলা টিপে শ্বাসরোধ করার পুলিশি কৌশল নিষিদ্ধ হয়েছে। চোকহোল্ড নামে পরিচিত এ কৌশল ব্যবহারের ফলেই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্কে পুলিশি বাজেট কমিয়ে সামাজিক উন্নয়ন খাতে তা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিয়াটলের মেয়র ৯০ দিনের জন্য কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। একাধিক অঙ্গরাজ্যে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের জন্য এক ডজনের মতো পুলিশ হয় চাকরি খুইয়েছে অথবা বিভাগীয় তদন্তের সম্মুখীন হয়েছে। 

পুলিশি ব্যবহারে সংস্কারের প্রধান অন্তরায় পুলিশ ইউনিয়ন। মিনিয়াপোলিসের পুলিশপ্রধান জানিয়েছেন, সংস্কারের প্রশ্নে পুলিশ ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাতেই তাঁরা যাবেন না। ইউনিয়নের চাপে এত দিন অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য দাপ্তরিক শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা গোপন রাখা হতো। দুই দিন আগে নিউইয়র্কের আইন পরিষদ সেই তালিকা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসেও পুলিশ ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে খসড়া আইন উত্থাপিত হয়েছে, তবে রিপাবলিকান বিরোধিতার মুখে সে প্রস্তাব যে গৃহীত হবে, তা প্রায় নিশ্চিত। 

এসবই লোক দেখানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মনে হতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনের ঢেউ যে আরও গভীর সে কথার প্রমাণ মেলে এত দিন যারা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে তাদের পরিবর্তিত অবস্থান থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেত আধিপত্যের একটি বড় প্রতীক মোটরগাড়ির গতি প্রতিযোগিতা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই প্রতিযোগিতার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। নাসকার নামে পরিচিত যে কোম্পানি এই প্রতিযোগিতার প্রধান উদ্যোক্তা, তারা এত দিন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শ্বেতকায় চালকদের নিজেদের গাড়িতে দাসপ্রথার সমর্থক কনফেডারেট ফ্ল্যাগ ঝুলিয়ে রাখার অনুমতি দিয়েছে। এখন তারা বলছে, কনফেডারেট ফ্ল্যাগ ব্যবহার চলবে না। আমেরিকার জনপ্রিয় ফুটবল লিগ এত দিন জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ হিসেবে হাঁটু গেড়ে বসার বিরুদ্ধাচারণ করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেসব খেলোয়াড়কে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলতেও দ্বিধা করেননি। এই লিগ এখন বলছে, তারা অশ্বেতকায় খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ করার অধিকার সমর্থন করে। 

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে এ দেশের শ্বেতকায়দের মধ্যে। চলতি পুলিশি ব্যবস্থার প্রধান সুবিধাভোগী দেশের শ্বেতকায় সম্প্রদায়। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সিএনএনের এক জরিপ অনুসারে, ৮৮ শতাংশ শ্বেতকায় আমেরিকান পুলিশি বৈষম্যের বিরুদ্ধে চলতি বিক্ষোভ ন্যায্য বলে মনে করে। মনমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক ভিন্ন জরিপ অনুসারে, দেশের ৭১ শতাংশ শ্বেত আমেরিকান মনে করে, বর্ণবাদ ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে একটি অব্যাহত সমস্যা। পাঁচ বছর আগেও এই মনোভাব পোষণকারী শ্বেতকায়ের সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও কম ছিল। 

মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের পেছনে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাষ্যকার ম্যাথু ইগলেশিয়াস একে ‘দ্য গ্রেট এয়েকেনিং’ বা মহাজাগরণ নামে অভিহিত করেছেন। এই মহাজাগরণের পেছনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁর খোলামেলা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী অবস্থান শহুরে ও শিক্ষিত আমেরিকানদের, বিশেষত নারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এই অসন্তোষের একটি বড় প্রমাণ মেলে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে তাঁর দুর্বল ভূমিকা ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের দাবি এসব শ্বেতকায় আমেরিকানের মনোভাব আরও নেতিবাচক করে তুলেছে। সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুসারে, আগামী নির্বাচনে তাঁর সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন এ মুহূর্তে ১০ থেকে ১৪ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। 

আমেরিকায় পরিবর্তন আসছে, এ কথায় যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের একজন হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এক ভাষণে ওবামা বলেছেন, ফ্লয়েডের হত্যা গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু পরিবর্তনের পক্ষে অভাবিত সুযোগেরও সৃষ্টি করেছে। তাঁর ভাষায়, ‘এ সুযোগের ব্যবহার করে সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে শুধু আমেরিকাকে বদলানো সম্ভব, তা–ই নয়, যে উন্নত আদর্শের প্রতীক এই দেশ, তা প্রতিষ্ঠাও সম্ভব।’

সত্যি শ্বেত আমেরিকা সেই পরিবর্তন চায় কি না, সে কথার প্রমাণ পেতে আমাদের আরও পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে।