আমেরিকায় বাঙালি খ্রিষ্টান
বুকের গভীরে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাড়ি জমায় প্রবাসে। ভিন্ন একটি দেশের ভিন্ন আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে একটি নতুন জীবনের অভিযাত্রা শুরু করে তারা। বাংলাদেশের বহু মানুষ রয়েছে এ প্রবাসী জীবনের আঙিনায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তারা গড়ে তুলেছে আপন ভুবন। বিশেষ করে গত কয়েক দশকে উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের একটি বিরাট সমাজ গড়ে উঠেছে, যাকে অনেক সময় ‘প্রবাসের মাটিতে এক খণ্ড বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করা হয়।
বাঙালিদের প্রবাসী হওয়ার সঠিক ইতিহাস, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী হওয়ার ইতিহাস বের করাটা একটু দুঃসাধ্য। তবে এর শুরু হয়েছিল ২৫০ বছরেরও আগে, যার তথ্যসূত্র ইন্টারনেটে প্রকাশিত কিছু গবেষণা নিবন্ধে পাওয়া যায়। এর পর সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো উত্তর আমেরিকায়ও পা বাড়িয়েছে লাখো বাঙালি। এরই অংশ হিসেবে এসেছে বাঙালি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও। ধীরে ধীরে কর্মসূত্রে ও অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এ দেশে বেড়েছে বাঙালি খ্রিষ্টানদের বসবাস।
আমেরিকায় বাঙালি খ্রিষ্টানদের পদার্পণ শুরু হয় আনুমানিক পঞ্চাশের দশকের আগে-পরে। প্রথমে মাত্র কয়েকজন বাঙালি খ্রিষ্টান কর্মসূত্রে এ দেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের মাধ্যমেই আসেন তাঁদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও ঘনিষ্ঠজনেরা। ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বাড়ে, তারা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে, জন্ম হয় নতুন ইতিহাসের। উত্তর আমেরিকা প্রবাসী অধিকাংশ বাঙালি খ্রিষ্টান এসেছে বাংলাদেশের দুটি অঞ্চল থেকে। এর একটি ঢাকা সদর দক্ষিণের দোহার-নবাবগঞ্জ থানার আঠারগ্রাম অঞ্চল, অন্যটি গাজীপুর জেলার ভাওয়াল অঞ্চল। এ ছাড়া খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ইত্যাদি অঞ্চল থেকেও এসেছেন অনেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের কলকাতা থেকে এসেছেন বেশ কিছু বাঙালি খ্রিষ্টান। বর্তমানে অধিকাংশ বাঙালি খ্রিষ্টান বসবাস করছেন নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, ক্যালিফোর্নিয়া, ডালাস, টেক্সাস, শিকাগো ইত্যাদি অঙ্গরাজ্যে। এ ছাড়া অন্যান্য জায়গায়ও বাঙালি খ্রিষ্টানারা বসবাস করছেন; তবে খুব সীমিত সংখ্যায়।
প্রথম দিকে যে কয়েকজন বাঙালি খ্রিষ্টান এ দেশে এসেছিলেন, তাঁদের মাধ্যমেই আমেরিকায় আসতে থাকেন তাঁদের পরিবার-বন্ধুরা। অনেকেই ডিভি ভিসা পেয়েছিলেন। অনেকে এসেছিলেন শিক্ষার্থী হিসেবে। কেউ কেউ আবার পর্যটন ভিসা বা কোনো সেমিনারে যোগ দিতে এসে রয়ে গেছেন স্বপ্ন পূরণের আশায়। যে যেভাবেই আসুক না কেন আজকের মতো সে সময়েও তাঁদের সবার স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর জীবন। আর এ জন্য বাঙালি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরাও অন্যদের মতো বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন পেশার কাজ। সময়ের পরিক্রমায় তাঁদের সন্তানেরা পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে কাজ করছে। নিজ নিজ পেশায় সফল হওয়ার পাশাপাশি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সবকিছু নিয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলছে এই প্রবাসী বাঙালিদের জীবনযাত্রা। একটি সুন্দর জীবন গঠনের স্বপ্ন তাড়নায় নিজেদের একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় সবার মাঝে! প্রবাসের পথচলায় যা কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে, তার জন্য হাপিত্যেশ না করে অর্জনের অদম্য স্পৃহায় সবাই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে-এটাই বাঙালির ‘হার না মানা’ প্রত্যয়।
জীবনের অংশ হিসেবে পেশাগত কাজ, সন্তান-সংসার নিয়ে ব্যস্ততা, ঘরে-বাইরে প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকার দৌড়ঝাঁপ, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় উৎসব-অনুষ্ঠানাদি সবকিছুতেই সমানতালে অংশ নিচ্ছে বাঙালিরা। বাঙালি খ্রিষ্টানরাও এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাঙালি খ্রিষ্টানরাও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গড়ে তুলেছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি নিয়ে জাতীয় দিবস থেকে শুরু করে নানা কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের চেতনায় সিক্ত তাদের মন। মনেপ্রাণে তারা প্রথমত এবং প্রধানত বাঙালি। মানুষ হিসেবে সবার ধর্মীয় বিশ্বাস যার যার অন্তরে রয়েছে। কিন্তু স্বদেশ ও শিকড়ের টান আর সবার মতোই অভিন্ন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা সম্পৃক্ত করছে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের। আর এর মাধ্যমে সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রবাসের মাটিতে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস। প্রবাসের মাটিতে মূলধারার বৃহত্তর অঙ্গনে মিশ্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে, আমাদের নিজস্ব পরিমণ্ডলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় যেকোনো প্রেক্ষাপটে নিজের বাঙালি সত্তাটি তুলে ধরার প্রয়াস থাকে লক্ষণীয়। এই প্রয়াসে বাঙালি খ্রিষ্টানরাও সহযাত্রী; এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে।
উত্তর আমেরিকায় বাংলার সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনাকে তুলে ধরতে গত দু দশকে বাঙালি খ্রিষ্টানরা আয়োজন করে চারটি সম্মেলনের। এর মধ্যে দ্বিতীয় সম্মেলনটি বাদে বাকি তিন সম্মেলন আয়োজন করেছিল ‘প্রবাসী বেঙ্গলি খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন’ এবং দ্বিতীয় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেরিল্যান্ডের স্থানীয় সংগঠনগুলোর সম্মিলিত আয়োজনে। সম্মেলনগুলোতে নতুন প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল।
সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছু। এ বদল ভবিষ্যতেও হবে। আর এ পথে বাঙালি খ্রিষ্টানদের বৃহত্তর সামাজিক চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হওয়াটা জরুরি। তাহলেই সামনের দিনে আমাদের পথচলা আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশকে উত্তর আমেরিকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার প্রয়াসে সমস্ত বাঙালি সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শুরু হোক আমাদের বাঙালি খ্রিষ্টান সমাজের নতুন যাত্রা। আমাদের পরিচয় হোক ‘আমরা গর্বিত বাঙালি’, তরুণ প্রজন্মের কাছে এ বাংলাদেশকে তুলে ধরাই হোক আমাদের প্রয়াস।