‘কমলাকে যে নিয়ম মেনে বিয়ে থা করিনি তার কতকগুলো কারণ আছে, কী জানি, নিজের বিয়ে দেখে এবং অন্য অনেকের বিয়ে দেখে আমার বিয়ের ওপর থেকে সমস্ত শ্রদ্ধা চলে গেছে। তবে ভালো স্ত্রীরা বা সঙ্গিনীরা যে কোনো পুরুষকে জীবনে অনেক বড় হতে এবং সার্থক হতে অনুপ্রেরণা দেয় এবং সাহায্য করে, সেটাও আমি খুব বিশ্বাস করি। কোনো সন্দেহই নেই সে বিষয়ে। তবে সেটা নিছক বিয়ের জন্য কি না, সেটা তর্ক সাপেক্ষ। ওই সার্থক সম্পর্কও তো আসলে একটা গভীর অন্তরঙ্গতা এবং ভালোবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে মন্ত্র পড়ে কার বিয়ে হলো, কার কী হলো, সেটা বড় কথা নয়। বিয়ে না হয়েও সেটা হতে পারে। কাজেই বিয়ে বলে যে মন্ত্র পড়া পড়ির একটা অজুহাত, সেটা না দেখালেই কি নয়? আসল কথা ভালোবাসা, বোঝাবুঝি, মানিয়ে চলা এবং একে অন্যকে বড় হতে দেওয়ার শুভ প্রচেষ্টা। পরস্পরকে সম্মান দিয়ে, ভালোবেসে যারা থাকতে পারে তারাই সুখী, তারাই আদত বিবাহিত। এবং সেটা কমলার সঙ্গে আমার হয়েছে। তাই আমি ওকে পেয়ে সুখী।’
‘অথচ এই কমলার প্রতিও আমি বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেছি। আনফেইথফুল হওয়া বলতে যা বোঝায়। বহুবার। কিন্তু আনফেইথফুল হওয়ার মাঝেও একটা কথা আছে। আনফেইথফুল আমি নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি তার জন্য ওর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নিইনি। আমাদের জীবনে যা হয়, অর্থাৎ অনেক দিন একলা একলা অনেক অনেক ঘুরতে থাকলে কিছু-না-কিছু এক্সপেরিয়েন্স আপনা থেকেই হয়ে পড়ে। এবং সেটা যারা স্বীকার করেন তাদের আমি বড় মানুষ হিসেবে মানতে বাধ্য। কিন্তু যারা এসব ঘটিয়েও সব অস্বীকার করেন তাদেরকে আমি নিম্ন স্তরের মনোবৃত্তির লোক বলেই ধরব।’
রবি শঙ্করের স্মৃতিকথা ‘রাগ অনুরাগ’-এ অকপটে তিনি নিজের জীবনসঙ্গিনী এবং প্রেমিকাদের নিয়ে কথা বলেছেন। রবি তাঁর এক নাম না জানা প্রিয় বান্ধবীর কথা বলেন, সেই রমণীই রবি শঙ্করের নিউইয়র্কের প্রেমিকা স্যু জোন্স। যার কথা রবি বলেছেন গলায় বিশেষ টান নিয়ে। আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয় যার নাম নোরা জোন্স। রবি শঙ্করের এই মেয়ে একজন প্রথিতযশা জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক এবং পাশ্চাত্য লোক সংগীতের শিল্পী ও সুরকার। নোরা জোন্স ২০০৩ ও ২০০৫ সালে ১০টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পরে রবিশঙ্কর তাঁর গুণগ্রাহী সুকন্যাকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে তাঁর দ্বিতীয় কন্যা অনুশকা শংকরের জন্ম হয়। বাবার কাছে শিক্ষা নিয়ে অনুশকা এখন নিজেও সেতার বাজিয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
তাঁর প্রথম যৌবনের প্রেম ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অন্নপূর্ণার সঙ্গে যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন বরের বয়স সবে ২১ আর কনের ১৫ পেরিয়েছে। উদারপন্থী আলাউদ্দিন খাঁর জেদে হিন্দু মতেই বিয়েটি সম্পন্ন হয়। এর কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম সন্তান শুভর জন্ম হয়। এরপর নানা কারণে রেওয়াজ, বাড়তি উপার্জন, সংসার এবং কমলার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্নপূর্ণার সঙ্গে রবির সম্পর্ক ভেঙে যায়। যদিও তাঁরা আইনের কাছে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করেননি।
কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবদান অহংকার করার মতো। বাঙালি হিসেবে তাঁকে নিয়ে বিশ্বের দরবারে আমরা গর্ব করতে পারি। ১৯৬৭ সালে তাঁর আমেরিকার অনুষ্ঠানমালা তাঁকে এক অভাবনীয় সফলতা এনে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের পর তাঁকে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কখনো মুচকি হাসি নিয়ে স্মরণ করেছেন জীবনের শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা যখন মানুষের ধারণা ছিল মুসলমান শিল্পী না হলে কিংবা নামের পেছনে খাঁ না থাকলে না কি শিল্পী হওয়া যাবে না! রাগে-দুঃখে রবি শঙ্কর ভেবেছিলেন নাম পরিবর্তন করে রব্বন খাঁ করে ফেলবেন। বাঙালি মানুষটি অন্য রকমের ডাক শুনতে পান হৃদয়ের মাঝে, নিজের ভাষাতেই বলেন—‘করছি কি আমি! আর কত দিন এসব! কি-ই বা দিলাম, কি-ই বা পেলাম! একেবারে বিরক্ত বিস্বাদ! কিছুই ভালো লাগে না! সেই গতানুগতিক প্লেনে চড়ে আজ এখানে, কাল ওখানে। হোটেলে থাকা, একঘেয়ে খাওয়া, punctually হলে যাওয়া, বাজনা বাজানো, তারপর হোটেলে ফিরে আসা নিশাচরের মতো মাঝ রাত্রে। ভালো লাগে না আর!’
অবসাদ থেকে খানিকটা মুক্তি পেতে, জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জনের জন্যই রবি শঙ্কর হাত পাতেন স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর কাছে, টাট বাবার শিষ্য হন এবং সত্য সাইবাবারও!
১৯৭৯ সালের ২১ মার্চ দার্জিলিংয়ে নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘রাগ-অনুরাগে’র মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন—‘যখন ভাবি এই লেখাগুলোর মধ্যে আমি কতখানি নিজের দোষ স্বীকার করে উঠতে পেরেছি তখন আর আমার আফসোস থাকে না। হাজার হোক, আমি তো দেবতা নই। যারা আমাকে দেবতা জ্ঞান করতেন তারা যদি আজ আমাকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে জেনেও ভালোবাসেন তবেই না জীবন সার্থক। উঁচু পিঁড়িতে বসে শ্রদ্ধা পাওয়ার অভিলাষ আমার নেই। যেটুকু গান বাজনা করেছি, মানুষকে যেটুকু আনন্দ আজ অবধি দিয়েছি, তার বিনিময়ে যেটুকু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা মানুষ আমায় দিতে পারেন তা পেলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। কারণ জানব, ওই টুকুই আমার সত্যিকারের পাওনা।’ বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন বাবাকে। তাঁর সেই বাবার নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। যিনি তার জীবনের আদর্শ, সমস্ত শক্তির উৎস।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের জন্য পড়তে গিয়ে এই মহান পুরুষের জীবনী আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। পড়ে মনে হলো, এত প্রেম না থাকলে কি সৃষ্টি হয় সুর? যেখানে সৃষ্টি বাসা বাঁধে সেখানে প্রেম আসবে। সুর বাসা বাঁধে বলেই সুরের ন্যায় প্রেম ঝরে পড়ে। এ যেন প্রকৃতির দান। তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন সরল স্বীকারোক্তিতে। ভালোবাসা পাওয়ার অদম্য যোগ্যতাকে কখনো কখনো চাইলেও দূরে ঠেলে দেওয়া যায় না। আবার সব গ্রহণও করা যায় না। যার হিসেব কেউ রাখলেও না। তাই যেন দুই হাতে তুলে নিয়েছেন প্রেম দেবীর এ বর। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো তার ব্যাখ্যা বদলে দেয় জীবনের মানে, দৃষ্টিভঙ্গি। গভীর কিছু বোঝার জন্যও গভীরতা চাই।