বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকটি নামীদামি টেলিভিশন চ্যানেলের খবর দেখা আমার রোজকার অভ্যাস। প্রায় প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসব চ্যানেলে চক্কর দিই। গত সপ্তাহে নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর দেখছিলাম ফ্রান্স টিভি। সংবাদ অনুষ্ঠানে এক বিশ্লেষক যখন বললেন, এখন আর মুসলমানরা বড় হুমকি নয়, সন্ত্রাসের বড় হুমকি এখন হচ্ছে সাদা সন্ত্রাসীরা।’ বিশ্লেষকের এ কথায় আমি নড়েচড়ে বসলাম। দু-একবার এমনতরো অভিমত মূলধারার গণমাধ্যমে শুনেছি, কিন্তু ফ্রান্স টিভির মতো এত স্পষ্ট ও সরাসরি অভিমত শুনিনি।
এর পরপরই পেলাম একটি পরিসংখ্যান। পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার মতো তথ্য। ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়েছে, নিউইয়র্কের অ্যান্টি ডিফেম্যাশন লিগ। যত দূর জানি, এই সংস্থাটি ইহুদিদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে থাকে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে আমেরিকাসহ বিশ্বে যে সব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার ৭১ শতাংশ করেছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা আর ২৬ শতাংশ করেছে মুসলিম সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালে আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। সংস্থাটির এই পরিসংখ্যান ওই বক্তব্যকে সমর্থন করছে, যেখানে বলা হচ্ছে, এখন হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরাই বিশ্বের জন্য বড় হুমকি।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যে উচ্চাসন ও উচ্চ মর্যাদায় এখন অধিষ্ঠিত, তা যেকোনো রাষ্ট্রীয় নেতার জন্য ঈর্ষণীয়। আমার মতে, শুধু প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণেই তা অর্জিত হয়নি। তাঁর মমত্ব, ভালোবাসা সর্বোপরি খাঁটি মানবিক গুণাবলির জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। তাঁর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা তাঁকে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছে। অবশ্য কেউ না কেউ যে তাঁর ওপর নাখোশ, তার প্রকাশ হয়েছে ইতিমধ্যেই। তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এক টুইট বার্তায় একটি বন্দুকের ছবি পোস্ট করে তাঁর উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী লক্ষ্য আপনি’। কর্তৃপক্ষ ওই টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে জেসিন্ডা আরডার্নকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার দাবি উঠেছে।
একটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, এই আমেরিকাসহ দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহৃত মিলিটারি স্টাইলের বন্দুক বা অস্ত্র নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হলেও সরকারগুলো তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে বা ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অতি দ্রুত তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে তাঁর দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জেসিন্ডা আরডার্ন সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছে বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটির সম্পাদকীয়র শিরোনাম হচ্ছে—‘নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের মতো ভালো নেতা প্রয়োজন আমেরিকার’।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, আতঙ্ক কীভাবে সামাল দিতে হয়, তা জেসিন্ডার কাছ থেকে বিশ্বের শেখা উচিত।’ হত্যাযজ্ঞে ব্যবহৃত অস্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রশংসা করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, নিউজিল্যান্ডে একটি হত্যাযজ্ঞ সরকারকে সজাগ করতে পারল। কিন্তু আমেরিকায় একের পর এক হত্যাযজ্ঞ হলেও কিছুই হয় না। সংকটের সময় নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত, তা শিখিয়েছেন জেসিন্ডা আরডার্ন।’
নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিউজিল্যান্ডে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-রক্তারক্তির মধ্যে জয় হয়েছে ভালোবাসার, জয় হয়েছে মানবতার। ভালোবাসা দিয়েছেন বাংলাদেশি জনাব ফরিদও। ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলায় নিহত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী হুসনে আরা। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বন্দুকধারী সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারান তাঁর স্ত্রী। ফরিদ তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়ে বলেছেন, সে ভুল করেছে, যখন তার ভুল ভাঙবে সেই প্রথম এগিয়ে আসবে আমাদের রক্ষায়! কী মহত্ত্ব, কী উদারতা! বর্তমান বিশ্বে এ উদারতা শুধু নিউজিল্যান্ডেই সম্ভব, এই পরিবেশ ও আবহাওয়া এখন ওই দেশে বইছে।
বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয়। অল্প কিছু লোক উগ্র বা চরমপন্থী। এ অল্পসংখ্যকরাই সন্ত্রাস ছড়িয়ে বিশ্বে অশান্তি জিইয়ে রেখেছে। এক শ্রেণির রাজনীতিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, অজ্ঞ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের হীন স্বার্থের জন্য এই সন্ত্রাসীদের পর্দার আড়ালে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে, যা খুবই বিপজ্জনক।
আমার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, সদুত্তর পাই না। প্রশ্নটি হলো—আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস-এর জনক কে বা কারা? কারা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে? অল্প কিছু মানুষের জন্য শত কোটি নিরীহ মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হবে কেন?
এক শ্রেণির মানুষ আছেন অশিক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য সহনশীল হতে পারছেন না, সম্প্রীতি রক্ষায়ও হচ্ছেন ব্যর্থ। তারা আবার সহজে ব্যবহৃত হচ্ছেন ধান্দাবাজ-স্বার্থান্বেষীদের গুটি হিসেবে। ‘আমারটাই শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র, আর বাকি সব বাতিল’—এই মন্ত্রণায় উজ্জীবিত করে তাদের যেভাবে উসকে দেওয়া হয়, এতে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের প্রয়োজন সুশিক্ষা। পরমত বা পরধর্ম সহিষ্ণুতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে তাদের।
দৃশ্যত ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সাদা সন্ত্রাসীদের দাপট বেড়েছে। ট্রাম্প অস্বীকার করলে কী হবে—হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা ট্রাম্পকে নিজেদের লোক বলেই ভাবে। তাঁর বিজয়েও তাদের বড় অবদান রয়েছে। দেশে-দেশে অভিবাসনবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে ট্রাম্পের খোলাখুলি ভূমিকার কথা সবার জানা। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এই উগ্র জাতীয়তাবোধকে চাঙা করেছে। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে জরুরি ঘোষণায়ও তিনি পিছপা হননি। এই উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এখন প্রবল বেগে বইছে। কোথাও কোথাও জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও অর্জন করেছে। একটা অমূলক ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, অভিবাসীরা এসে ইউরোপ-আমেরিকার সব দখলে নিয়ে নিচ্ছে, শ্বেতাঙ্গরা হয়ে যাচ্ছে সংখ্যালঘু, অভিবাসীদের রুখতে হবে—এখনই। এই বাজে অপপ্রচার সন্ত্রাসকে উসকে দেওয়ার জন্য যে যথেষ্ট, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এদিকে সত্য হচ্ছে, আধুনিক ও উন্নত ইউরোপ-আমেরিকা নির্মাণে অভিবাসীরা বড় ভূমিকা রেখেছেন এবং এখনো রাষ্ট্রগুলোর চালিকা শক্তির এক বড় অংশীদার অভিবাসীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নোংরা রাজনীতি ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড পরিহার না করলে বিশ্বে মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আমাদের করণীয় বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতে দেখা যায় বা শোনা যায়। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর নিউইয়র্কের বিভিন্ন মসজিদে মার্কিন আইন প্রণেতা ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও সংহতি প্রকাশ করে দেওয়া বক্তব্য সবার মনে স্বস্তি দিয়েছে। নামাজ শেষে দোয়ায় আমেরিকার প্রতি রহমত বর্ষণের প্রার্থনাও ছিল হৃদয়গ্রাহী।
আমার মতে, আমেরিকান সমাজের সঙ্গে আমাদের বন্ধনকে আরও ঘনিষ্ঠ করতে হবে। আমি নিউইয়র্কের রাস্তায় প্রায়ই দেখি, ক্যাথলিক চার্চের খাদ্যবাহী ভ্যান বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে খাবার সরবরাহ করছে। এটা এক–দুদিনের ঘটনা নয়, বছরব্যাপী কর্মসূচি। এতে চার্চের সঙ্গে সমাজের বা অনুসারীদের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। মসজিদ কেন্দ্রিক সামাজিক ও মানবিক কর্মসূচি চালু করা যায় কিনা, তা সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করবেন বলে আশা করতে পারি।
খবরে দেখেছি, আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারে অচলাবস্থার সময়ে বেতনবঞ্চিত কর্মচারীদের ভোজে আপ্যায়িত করেছে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার। খুবই প্রশংসনীয় কাজ। অনুরূপ সেবাধর্মী কাজের আরও বিস্তৃতি দরকার। ওই সময়ে টিভিতে দেখেছি, সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র ফেডারেল কর্মচারীদের জন্য পিৎজা বয়ে নিয়ে গেছেন। উল্লেখ্য, এক সপ্তাহ আগে নগর কর্তৃপক্ষ জ্যামাইকা মসজিদের সামনের রাস্তার নামকরণ করেছেন মসজিদের নামে—জেএমসি ওয়ে।
নিউইয়র্কের সাময়িকী মদিনার আলোর প্রকাশক ও সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ টুপন প্রায় প্রতি বছর ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’–তে জ্যাকসন হাইটসে খোলা জায়গায় হোমলেসদের মধ্যে খাবার বিতরণ করতেন। তাঁর এই কর্মসূচি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। জানি না, তাঁর এ সেবা এখনো চালু আছে কিনা।
মোদ্দা কথা, আমাদের কমিউনিটিকে এমন সব সামাজিক, মানবিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে যাতে এই বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ হয়। এই সমাজ যখন ভাববে ও বিশ্বাস করবে, আমরা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অ্যালিয়েন নই, এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরোপকারী মানব, তখন আমাদের নিরাপত্তাসহ সব অধিকার ভোগে সমাজই হবে গ্যারান্টি।
মানবতা ও ভালোবাসার যে জয় আমরা নিউজিল্যান্ডে দেখলাম, এই মানবতা ও ভালোবাসা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ুক, হিংসা-বিদ্বেষ দূর হোক, সবাই থাকুক শান্তিতে—এই-ই আমার চাওয়া।
লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক