[১৯৭১ সালের মার্চ মাস বাঙালির গৌরবের মাস। এ মাসের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই গোটা বাংলাদেশেই এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে। ছাত্র-শিক্ষক, আমজনতা, কৃষক মজুর, গৃহিণী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ তখন বুঝে ফেলেছিল, স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আর নয়। দেশ তখন স্পষ্টতই এক অজানা আতঙ্কের দিকে যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছুদিন পর অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে মুক্তিকামী নিরীহ বাঙালির ওপর হঠাৎ করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে এই পাকিস্তানি হায়েনারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার এবং হত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনকে শক্ত হাতে দমন করার নামে তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বাঙালি নিধনে নামে। পুরান ঢাকার তাঁতি বাজারে আগুন দিয়ে শত শত নিরস্ত্র মানুষকে তারা হত্যা করে, রাস্তার আশপাশে বস্তিতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের এই নিষ্ঠুর আক্রমণে গোটা বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। টাইম সাময়িকীর দৃষ্টিতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর যে নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, তাতে প্রায় তিন লাখ বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। অনুমান করা হয়, শুধু ঢাকা শহরেই এক লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর যেকোনো বর্বরতম হত্যাকাণ্ডকেও হার মানায়। আজকের লেখায় যে তিনজন বিশিষ্ট লেখক এবং সাংবাদিক ১৯৭১ সালের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতিকথা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তারা হলেন সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ, লেখক ও অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ এবং লেখক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজউদ্দীন হোসেনের ছেলে ফাহিম রেজা নূর। তাঁদের সবার প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।]
[নিনি ওয়াহেদের মুখে সেই বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতিচারণ]
২৪ মার্চ গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে কমিউনিটি সেন্টারের মহিলা পরিষদের সভা। আমি সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ আমাদের বলা হলো, তাড়াতাড়ি সভা শেষ করতে হবে। খবর পাওয়া গেছে, দেশের অবস্থা ভালো নয়। যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটতে পারে। আমরা সভা শেষ করে বাড়ি ফিরলাম। ঢাকার অবস্থা ছিল তখন থমথমে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গভীর রাতে হঠাৎ অপারেশন সার্চলাইট নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদল নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে এক ভয়াল বিভীষিকাময় কালরাত্রি। আমরা তখন বাড়ির ছাদে উঠে দেখেছি, পাকিস্তানি সেনারা পুরান ঢাকার তাঁতি বাজার আর শাঁখারি বাজারে আগুন দিয়েছে। সেই লেলিহান আগুন থেকে বাঁচতে যারাই দোকান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল, তাদের গুলি করে মারা হচ্ছিল।
হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে কিছু ছাত্রদেরও পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পূর্ব বঙ্গকে পুরোপুরিভাবে পঙ্গু করে দেওয়া। সেই লক্ষ্য পূরণে তারা রাজারবাগ পুলিশ স্টেশন, ইপিআর, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, টিভি, রেডিও স্টেশন দখল করে নিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর গুলি চালাল। আমরা তখন শুনেছি, পাকিস্তানি সেনারা পাকিস্তান থেকে অনেক অস্ত্র নিয়ে আসছে। আমরা প্রত্যাশা করছিলাম, যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ করব। কিন্তু কীভাবে করব, সেটা আমরা তখনো জানতাম না। তবে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যে সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে নামবে, তখন তা আমাদের জানা ছিল না। মনে আছে টিক্কা খান বলছিল, ‘আমি দুই সপ্তাহের মধ্যে গোটা বাংলাদেশকে ধ্বংস করে ফেলব।’
২৫ মার্চের কাল রাতের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা শাসকেরা বাঙালি জাতিকে সমূলে নির্মূল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।
[লেখক আশরাফ আহমেদ যেমন দেখেছিলেন, শুনেছিলেন। তিনি এখন মেরিল্যান্ডের পটোম্যাকে বসবাস করছেন]
মার্চের ২৫ তারিখ আমি ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সন্ধ্যায় আমার আর আব্বার দাওয়াত ছিল পৈরতলায় ফুপুর বাসায়। আমার ফুপাতো ভাই মাখন ভাই ছিলেন স্থানীয় রেডক্রসের চেয়ারম্যান। চার মাস আগে সত্তরের নভেম্বরে প্রলয়ংকরী সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী এসেছিল বিদেশ থেকে। সে সব বিতরণের ব্যাপারে পরামর্শ করতে এই দাওয়াতের আয়োজন করেছিলেন। পায়ে হেঁটে ফেরার সময় কোনো একটি বাসা থেকে রেডিওতে ঢাকা বেতারে রাতের খবর প্রচার হচ্ছিল। আব্বার উৎসাহে পথে দাঁড়িয়েই মনযোগ দিয়ে শুনলাম। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে রাওয়ালপিন্ডি রওনা হয়ে গেছেন। খবরে মুজিবের সঙ্গে আলোচনার কথা কিছু ছিল না।
আব্বা বললেন, আলোচনার কী হলো না জানিয়েই ইয়াহিয়া চলে গেল। ঘটনা তো আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। ওরা না জানি আবার কী চাল চালছে!
আমার রাজনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে লিখতে গিয়ে আব্বার কথা আগেও লিখেছি। দুর্বল স্বাস্থ্যের এই লোকটিকে বাইরে থেকে গম্ভীর দেখালেও নিকটজনের কাছে তিনি ছিলেন মিতভাষী ও মিষ্টি হাসির মানুষ। আমরা বড় হতে থাকলে তাঁকে এক ধার্মিক মুসলমান হিসেবেই দেখেছি। আগে পাকিস্তান সৃষ্টিকে সমর্থন করলেও পরে বাংলার অধিকারকে প্রাধান্য দিতেন। সেজন্য শেখ
মুজিবকে পছন্দ করতেন। আমার সঙ্গে দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি সমাজতন্ত্রের কথা বললে তিনি ইসলামিক সমাজতন্ত্র চাইতেন।
প্রতিদিনের মতোই আজও আমি ঘুমাতে গেলাম আমাদের মূল ভবন থেকে আলাদা পুবের ঘরে। তাড়াহুড়া করা যা একেবারেই অভ্যাস নয়, আজ তাই করে আব্বা অস্থির কণ্ঠে আমাকে ‘তাড়াতাড়ি ওঠ’ বলে ডাকতে লাগলেন। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই উত্তেজিত ও কম্পিত কণ্ঠে বলতে থাকলেন, ‘ঢাকায় কেয়ামত হয়ে গেছে, গতকাল রাতের খবর শুনেই আমার এরকম হবে ভয় হয়েছিল।’
চিটাগাং মেইল ট্রেন মাঝ রাতের পর ঢাকা ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থামে রাত সাড়ে তিনটা বা চারটায়। অভ্যাস মতো আব্বা ফজরের আজানের আগে বাইরের ঘরের সিঁড়িতে বসে অজু করছিলেন। সে গাড়িতে আসা কয়েকজন যাত্রী আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়
অজু করতে থাকা আব্বাকে ঢাকার অবস্থা জানিয়ে গেল।
সকাল-দুপুর পাড়ার বন্ধু, ছাত্র, বয়স্ক মানুষ এবং আব্বা-চাচা, সবার সঙ্গে ঢাকায় কী হচ্ছে, এসব নিয়ে কথাবার্তায় কেটে গেল। যতটা বুঝতে পারছিলাম, ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। তবে তার ভয়াবহতার কথা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
আমাদের চিন্তার বড় কারণ ছিল, বড় ভাইকে ফজলুল হক হলে আমার কক্ষে রেখে এসেছি। বড় আপা-দুলাভাই তিন মেয়ে ও শাশুড়ি-ননদদের নিয়ে থাকেন অবাঙালি অধ্যুষিত মোহাম্মদপুরে। আর জানু মামারা থাকেন আরও দূরে ততধিক অবাঙালি অধ্যুষিত শ্যামলীতে। এ ছাড়া ঢাকায় আরও আছেন তিন খালা, দুই মামা ও ফুপুদের পরিবার।
[সেই সময় ছাত্র ফাহিম রেজা নূরের স্মৃতিতে ঢাকার অবস্থা]
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই দেশে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আব্বা (শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন) সব সময় আমাদের বলতেন, ‘দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে।’ আমরা তখন থাকি ঢাকার চামেলিবাগ এলাকায়। এলাকার বড় ভাইয়েরা রাস্তায় ব্যারিকেড বানিয়ে টহল দিচ্ছে। আমার বড় ভাই শাহিন ও শামিম—তারাও তখন এই কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আব্বা আমাদের ভাইদের বললেন যেন বাড়িতে চাল-ডাল যথেষ্ট পরিমাণ কিনে মজুত করে রাখি। তিনি আমাদের আভাস দিয়েছিলেন, দেশের অবস্থা ভালো নয়। যেকোনো সময়, যেকোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
২৫ মার্চের রাত। আব্বা হঠাৎ করে বাসায় টেলিফোন করলেন। আম্মার সঙ্গে কথা বললেন। আব্বা শুধু বললেন, ‘সাবধানে থেকো’। আমার বড় ভাই আব্বাকে নিশ্চিত করলেন, আমাদের আড়াই মন চাল কিনে মজুত করা হয়েছে। রাত তখন ১১টা বাজে। হঠাৎ করেই গোটা শহর অন্ধকার হয়ে গেল। কোনো আলো নেই। আর সঙ্গে সঙ্গেই টিনের মতো ঝন ঝন একটি শব্দ সারাক্ষণ কানে বেজেই চলছে। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম, ভারী অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদের আওয়াজ। আমাদের
বাড়ির পেছনেই একটা পুকুর ছিল। রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা সেই পুকুরের পাড়ে একটি টিনের ছোট বাড়ি করে থাকত। বুঝতে পারছিলাম, পাকিস্তান আর্মি রাজারবাগ পুলিশ ফাড়ি আক্রমণ করেছে। পুলিশ সদস্যরাও তাদের প্রতিহত করতে নেমে গেল। তাদের অস্ত্রও গর্জে উঠতে শুরু করল।
এদিকে আমাদের বাড়িটিই ছিল সাড়ে তিন বেড রুমের একটি বড় দালান বাড়ি। ধীরে ধীরে আমাদের বাড়িটি প্রায় শ দুয়েক লোকে ভরে গেল। আম্মা ঘরে চাল-ডাল যা ছিল, তা দিয়েই সবাইকে আপ্যায়ন করলেন। গোটা রাত এভাবেই কাটল। পরদিন দেশে কারফিউ জারি হলো।