দেখিস, একদিন আমরাও
নিউইয়র্কেও কাক ডাকে। জ্যাকসন হাইটসের অন্য সব কোলাহলে কাকের ডাক আর শোনা হয়নি। সকাল সাতটা ছুঁই ছুঁই। মাথার পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। সমস্ত অলসতা বিসর্জন দিয়ে ১৫ মিনিটে প্রস্তুত হতে হয়। দরজায় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় দুই ব্যক্তি। সাহিত্যিক আহমাদ মাযহার ও ফারুক ফয়সল। তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়া সারা দিনের জন্য। বেরিয়ে পড়া হাসি-আনন্দে কাটানোর প্রত্যয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য, আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি।
শুরুতে ড্রাইভিং সিটে আমাদের সহকর্মী মনজুরুল হক। এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সকাল আটটায় নিউজার্সিতে ক্ষণিকের যাত্রাবিরতি আমাদের যাত্রীদলের নেতা বন্ধুতুল্য অভিভাবক ইব্রাহীম চৌধুরীর বাড়িতে। ডিম-পরোটার প্রাতরাশের পর দেয়ালে ঝোলানো চিত্র দেখতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি; হাতে করা সেলাইয়ে গ্রামবাংলার চিরচেনা রূপ। ক্ষণিকের জন্য এই ছবিতেই বিলীন হয়ে যাই। নিজের সত্তাকেই যেন হারিয়ে ফেলি। সেখানে খুঁজে পাই আমার নিজের বাড়ির ঘর। মা, বোন, আর সহধর্মিণীর হাতে করা সেলাইয়ের কারুকাজ। নকশি কাঁথা, বালিশ কভার, কুশন, হাতপাখা, আর দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি। আমার কাছে সেগুলো শুধু হাতের কাজ নয়। সেখানে বিমূর্ত হয়ে আছে তাদের হৃদয়ের স্নেহ, মমতা, আর ভালোবাসার ছোঁয়া।
ইব্রাহীম ভাইয়ের হাঁকডাকে আবার যাত্রা শুরু। পাড়ি দিতে হবে চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ। গাড়িতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, যার কোনো সীমা নেই। হাসি-আনন্দ। বাদ যায়নি তর্ক-বিতর্ক। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা, কবি সাহিত্যিকদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা উঠে আসে কথায় কথায়। সনেট, স্বতন্ত্র সনেট, বাংলা সিনেমা, বাদ যায়নি হাস্যরসে পূর্ণ মজার মজার কৌতুকও। ‘আমি অকৃতি অধম’, যেন নতুন এ বিদ্যালয়ের আনকোরা ছাত্র। প্রথম ক্লাসে এসে বসেছি; কত কী শুনছি, শিখছি, আর অভিভূত হচ্ছি। তাদের জানার পরিধির ব্যাপকতা, জ্ঞানের গভীরতা, আর দৃষ্টিভঙ্গির দূরদর্শিতা দেখে বিস্মিত হচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছিল, কত অজানারে!
এদিকে কখনো ৬০, কখনো ৭০ মাইল বেগে সাঁ সাঁ করে গাড়ি চলছে। মেঠো গ্রামের সবুজ ধানের খেতের নালায় কলকল রবে বহমান পানির শব্দ হচ্ছে যেন। মহাসড়কের দুপাশে শুধুই বৃক্ষরাজি; অনেকটা ছবির মতো। চলছে আমাদের গাড়ি, বহু লেনের একমুখী এ পথের কোথাও কোনো বাধা নেই। দুই পাশের পাতাহীন গাছেরা যেন কিছু জানান দিচ্ছে। কী? আমেরিকায় বসন্তের আগমনী। এদিকে কখনো হাসি, কখনো কঠিন, কখনো ভাবগম্ভীর আলাপ চলছে সমানতালে। শুধু কথায় কী আর চলে! দলের সবার ভেতরে এক কাপ কফির তাড়না একযোগেই দেখা দিল। হাইওয়ের পাশে সার্ভিস স্টেশন। সেই পেট্রল পাম্পেই গাড়িতে তেল ভরা চলল। সঙ্গে নিজেদের ইঞ্জিনের রসদ জোগান হলো। কফি কেনা ও বানানো নিজেদেরই করতে হলো—এখানে সবই করতে হয় নিজেকে। পশ্চিমা রীতি!
আবার যাত্রা হলো শুরু। সারি সারি গাছ ছাড়িয়ে কিছু দূর পরপর এক-দুটি স্থাপনা। কিছু কিছু ভবনের মন জুড়ানো নকশা। দেখা মেলে বিভিন্ন কারুশিল্প; চোখ আটকে যায় আমার। আবার থামল গাড়ি। পার্কিংয়ে হুজ্জত আছে, তাই সময় দেওয়া হলো ১০ থেকে ১৫ মিনিট। ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের সামনে আমরা। দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। ভিজিটর সেন্টারে প্রবেশ করে জানা যায়, এর শৌর্যবীর্যের ইতিহাস। এখান থেকে শুধু আমেরিকা নয়, বলা যায় শাসিত হয় আজকের বিশ্ব! আমাদের সবার মধ্যে ছবি তোলার ব্যস্ততা। সেলফি তোলার চেষ্টা চলছে এমন সময় এক ভদ্রলোক পাশ থেকে বললেন, ক্যান আই হেল্প ইউ? এখানে ভদ্রতা, বিনয় ও সহযোগিতার যে মনোভাব দেখা যায়, তা নিজেকেও উৎসাহিত করে। পরের গন্তব্য ন্যাশনাল মল। এখানে দাঁড়িয়েই মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম!’ আমরা সবাই আপ্লুত হয়ে তাঁর স্মৃতিতে নির্মিত ‘মনুমেন্ট’ দেখি।
গাড়ি পার্ক করে এবার হাঁটার পালা। রাস্তায় সারবদ্ধ করে রাখা আছে বাইসাইকেল। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে সাইকেল দিয়েই ঘোরা যায় সব জায়গায়। রাস্তাগুলো নিরাপদ। ন্যাশনাল মলের মনুমেন্ট, মিউজিয়াম ও পেছনের বিশাল খালি জায়গায় সময় কাটানো; সে এক অন্যরকম অনুভূতি। খোলা আকাশে উড়ছে ঘুড়ি। ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারি ভবনের সামনে অপেরার মর্মর সুরের তালে গান গাইছেন এক নারী। সামনের খোলা জায়গায় কিশোর-কিশোরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইলেকট্রিক বাইক নিয়ে। চলছে বাছাই করা পথচারীদের বিভিন্ন কসরত প্রদর্শন। একটু সামনে হাঁটলেই হোয়াইট হাউস। সাদা ভবনের উত্তর পাশটা লোকারণ্য। নানা দেশের, নানা বর্ণের লোকজন এর সামনে জড়ো হয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন তাদের নিজ নিজ দাবির প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে স্লোগান উঠছে। একটু খেয়াল করতেই অবাক হওয়ার পালা। কারণ একদল ইসরায়েলের পক্ষে। আরেক দল বিপক্ষে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে তারা। নেই কোনো ধস্তাধস্তি বা হাঙ্গামা। যেন সব মত ও পথের অবাধ যাতায়াত। নেই কোনো পুলিশের দঙ্গল। কখনো সরব, কখনো নীরবে চলছে তাদের প্রতিবাদ। অবাক হই কমরেড ফিলিপসকে দেখে; তাঁর কথা জেনে। ৩৭ বছর ধরে হোয়াইট হাইসের পাশে অবস্থান করে মানবাধিকারের কথা বলে চলেছেন এই সর্বত্যাগী মানুষটি।
ওয়ার্ল্ড ওয়ার-২ মেমোরিয়াল, ইউনিয়ন স্টেশন প্লাজা ও ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকা দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে আসে। সন্ধ্যায় পাশের রাজ্য ম্যারিল্যান্ডে স্বদেশিদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া দিনটিতে অন্য রকম এক মাত্রা যোগ করে। ঢাকা থেকে ১৩ হাজার মাইল দূরে এসে সকলের অল্প সময়ের আলাপচারিতা ও আতিথেয়তায় মনে হচ্ছিল আমরা সবাই শুধু বাংলাদেশি নই, আমরা একই বাড়ির, একই পরিবারের সবাই। রাত তিনটায় নিউইয়র্কে ফিরে এলে একটি দিনের সমাপ্তি ঘটে ঠিকই, শেষ হয় না হৃদয়ের কুঠুরিতে জড়ো হওয়া মণি-মাণিক্যের ঝলকানি। দিনটির অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেয়—আমার দেশটি এখনো কত পিছিয়ে! মনে তবু আশা জাগে। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা আমাদের আশার ভিত্তিকে মজবুত করছে। তাই হতাশা নয়, ভাবনার অতলে মনে দোলা দেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই পঙ্ক্তি- ‘দেখিস, একদিন আমরাও।’