কবিতা লেখায় ফেরা

কেন যে আমি এমন সৃষ্টিছাড়া হলাম, এই ভাবনা আমার কোনো দিনই যাবে না। আমার সময়ে পুরোনো ঢাকার মেয়েদের অবসরের প্রধান বিনোদন ছিল ভিসিআরে হিন্দি সিনেমা দেখা। ভাড়া করে ক্যাসেট এনে জিতেন্দ্র-শ্রীদেবীর নাচে-গানে ভরপুর বই দেখে অবসরের সময়টুকু কাটাত সবাই। আমাদের গেন্ডারিয়ায় ঢাকাইয়া আর বিক্রমপুরের মানুষের সংখ্যাধিক্য ছিল। তারা সিনেমাকে বলতো ‘বই’। আমার প্রতিবেশী বান্ধবীরা বিকেলবেলা সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লে ছাদে উঠে গল্প করত। সেই ‘বই’ দেখা, ছাদে উঠে গল্প করার মতো লোভনীয় সব আকর্ষণকে উপেক্ষা করে, বাবার বকুনি-মায়ের নিষেধ না মেনে, বাসে-টেম্পোতে চেপে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র আর কণ্ঠশীলনে যেতাম। কেন যেতাম? যেটা এখনো আমার কাছে বিস্ময়। 

সেই আমি যে নিউইয়র্ক শহরে আসার পরে একটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইব সেটাই তো খুব স্বাভাবিক। সেই চেতনার উন্মেষকালে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছিলেন, সাংগঠনিক দক্ষতা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুন। একজন মানুষ সৎ, সত্যবাদী, পরোপকারী, পরিশ্রমী, দক্ষ– যত গুনের অধিকারী হোক না কেন, সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকলে সে পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হতে পারে না। আশপাশের আর দশটা মানুষের চোখে যারা ‘পাগল’ ‘খ্যাপাটে’ ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ানো’ তারাই যে আদতে অগ্রসর মানুষ! স্যারের কাছ থেকে শোনা এই কথাগুলো সারা জীবনের জন্য বিশ্বাসের মণিকোঠায় আর মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেঁথে রাখলাম।
তেমনই একজন ‘খ্যাপাটে’ মানুষের দেখা পেলাম অবশেষে। সময়টা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি হবে। জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারা অফিসে গিয়েছিলাম একটা বইয়ের খোঁজে। হাতে ধরা শিশু সন্তান। চারদিকে বইয়ের সমারোহে মন আনন্দে মদিত। পরিচিত একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম কণ্ঠশীলন প্রসঙ্গে। খুব ভালো লাগছিল অনেক দিন পরে।
‘আপনি কণ্ঠশীলনে ছিলেন? আমিও তো কণ্ঠশীলনের সদস্য ছিলাম।’
বেশ ভারী একটা কণ্ঠ পাশ থেকে বলে উঠল। সামান্য চমকে তাকিয়ে দেখি মাথায় হ্যাট পরা একজন মানুষ। একদিনে এত সমমনা মানুষ পেয়ে আমি তখন আনন্দে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। সালাম বিনিময়ের পরে কণ্ঠশীলনের কোন আবর্তনে ছিলেন সেই তথ্য জানা হলো। পরে উনি একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, ‘এই নিন আমাদের সংগঠনের ঠিকানা। অবশ্যই আসবেন।’
দৈবচয়নের মতো সেদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল সাহিত্য একাডেমির কর্ণধার মোশাররফ হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে। কারণ, আমি যেমন মানুষ, একটা সংগঠনে একবার ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে গেলে সারাজীবনেও সেটা ছাড়তে পারি না। বাংলাদেশের সাহিত্যের বাচিক চর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠান ‘কণ্ঠশীলন’ এ আমার সামনে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরল, আবার সংগঠিত হলো, আমি থেকে গেলাম মূলের সঙ্গে, পরিবর্তন জিনিসটা ঠিক যেন আমার সঙ্গে যায় না।
সেই আমি জীবনের সবচেয়ে পরিবর্তনের পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এলাম নিউইয়র্কে। বাসা নিলাম জ্যাকসন হাইটসে। জীবনে কোনো দিন ঘুণাক্ষরে ভাবিনি বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হব। থিতু হয়ে আসা প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে নতুন শহরে মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। জীবনানন্দ দাশের অতি পরিচিত কবিতা ‘বনলতা সেন’ এর মতো সেই সময়ে আমাকে দু দণ্ড শান্তি দিয়েছিল সাহিত্য একাডেমি। বাসা থেকে কাছে হওয়ায় একদিন দুরুদুরু দুরুদুরু বুকে সিঁড়ি ভেঙে উপস্থিত হলাম সাহিত্য একাডেমির সভায়। কবিতা পাঠ ও আলোচনা ভালো লাগল। ক্রমে প্রতি মাসে যাওয়া শুরু করলাম। নিউইয়র্কে থাকলে সাধারণত উপস্থিত থাকার আন্তরিক চেষ্টা থাকত মাসিক সভাগুলোতে। ধীরে ধীরে আমি যেন ফিরে পেতে লাগলাম, আমার প্রিয় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র কিংবা কণ্ঠশীলনের দিনগুলোকে।
সাহিত্য একাডেমির কোনো নির্বাচিত কমিটি নেই। নির্বাচন নেই বলে ভোটার হিসেবে কোনো গুরুত্বও নেই। অন্যান্য সংগঠনের মতো মূল উদ্দেশ্য পাশ কাটিয়ে বনভোজন কিংবা ফ্যামিলি ডে উদ্‌যাপনের ব্যস্ততা নেই। কীভাবে যে সংগঠন পরিচালিত হয় হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেউ জানে না। তবু দেখি, তুষারপাত, ব্লিজার্ড কিংবা মাইনাস আবহাওয়াতে ভরে যায় মাসিক আসরগুলো। কারও মুখে কোনো অভিযোগ দেখি না। অন্য কোথাও গেলে দেখি বেশির ভাগ সাহিত্য একাডেমিরই মানুষ। ছড়াকার মনজুর কাদের ভাই কথাটা প্রায়ই বলেন। ওনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যায়।
দেখছেন এখানে সবাই আমরা সাহিত্য একাডেমির মানুষ।
মনজুর কাদের ভাইয়ের মতো ধীরে ধীরে আমিও নিজেকে একজন সাহিত্য একাডেমির মানুষ ভাবতে ও পরিচয় দিতে শুরু করলাম।
শুরুর দিকে সাহিত্য একাডেমির সভায় গিয়ে আমি কি করব- কি পড়ব এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতাম। কণ্ঠশীলন থেকে সবে এসেছি বলে মাঝেমধ্যে বড় কবিদের কবিতা পড়তাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সদস্য ছিলাম বলে কখনো বই নিয়ে আলোচনা করতাম। মাঝেমধ্যে নিজের লেখা কবিতাও পড়তাম। যেগুলো আসলে অনেক আগের লেখা। ছাত্রজীবনে প্রেমে পড়ার বয়সে কিছু রোমান্টিক কবিতা লিখেছিলাম, সেই সব ছিল পুঁজি। কিন্তু, এই পরিণত বয়সে এসে সেসব কবিতা পড়তে ভালো লাগত না। নতুন করে কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার অভিজ্ঞ কান সেই সব পাঠ শুনে বুঝল, এখনো তেমন কিছু হয়নি। ভাবলাম, আমার দ্বারা হবে না। তবে আমি হাল ছাড়লেও সাহিত্য একাডেমির পরিচালক মোশাররফ ভাই হাল ছাড়লেন না।
মনিজা, আপনি কবিতাই লিখবেন। লেখা বন্ধ করবেন না। দেখবেন এক সময় আপনার উন্নতি হবে।
আমি ভরসা পেলাম। আগেই বলেছি, আমি পরিবর্তন বিমুখ একজন মানুষ। খুব সহজে নতুনকে মেনে নিতে পারি না। সারাক্ষণ অতীতে বাস করি। এই শহরে এসে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া অন্য সবার মতো সহজ ছিল না আমার। সেই কষ্টগুলো এত দিন বুকে পুষে রাখতাম। আস্তে আস্তে সেটা কবিতায় অনূদিত করতে লাগলাম। অনেক হালকা হলো মন। ক্রমে বুঝতে পারলাম, জীবনের প্রচণ্ড আবেগকে প্রকাশের জন্য কবিতাই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কারণ গদ্যে আবেগের চেয়ে যুক্তির, হৃদয়ের চেয়ে মস্তিষ্কের ব্যবহার বেশি। নমস্য কবি বিনয় মজুমদারের কবিতার ভাষায় মনে হলো-
‘কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকার এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
………………..
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।
নির্ভয় দিলে একটা ঘটনা বলি। নিউইয়র্কে আসার পরে বিখ্যাত কবি ও স্থানীয় বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক তমিজউদ্দীন লোদী ভাইকে একটা কবিতা দিয়েছিলাম। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবার ছন্দে লিখেছিলাম কবিতাটি। জানতাম, ভালো হয়নি। লোদী ভাই আমার কবিতা পড়ে বলেছিলেন, ‘আপনার উচিত হবে ছোট গল্প লেখা। আমি আপনার ছোট গল্প পড়েছি। বেশ ভালো হয়। সেটাই চেষ্টা করেন।’
লোদী ভাইয়ের কথায় আমার মন খারাপ হয়নি। কারণ তখনো আমি কবিতায় নিজের বৈশিষ্ট্য দাঁড় করাতে পারিনি। ক্রমে কবিতা লেখায় নিয়মিত হলাম। সাহিত্য একাডেমির প্রত্যেক সভার জন্য নতুন কবিতা লিখতে হতো। সেই লেখা নিউইয়র্কের স্থানীয় পত্রিকাতেও দিতাম। আমার পরিচিতরা অবাক হতো ‘কবি’ হিসেবে আমার প্রকাশের চেষ্টায়। যেহেতু দীর্ঘ বিশ বছরের বেশি সময় পেশাদার সাংবাদিকতা করেছি, তাই নিজেকে একজন সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিই সাধারণত সব জায়গায়। আমাকে পেশায় আসার প্রথম থেকে যাঁরা চিনতেন, তাঁদের অনেকেই এই নিউইয়র্ক শহরে থাকেন, তাঁরা আমাকে ফোন করে বললেন- ‘মনিজা, তুমি যে কবিতা লেখ, এত দিন তো জানতাম না!’ বিশেষ করে ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা লিখে এত সাড়া পেলাম যে বলার নয়! আমাকে গদ্য লেখার জন্য উৎসাহিত করা লোদী ভাই কিছুদিন আগে তাঁর পত্রিকায় স্বাধীনতা দিবস সংখ্যার জন্য আমার কবিতা চাইলেন। সাহিত্য একাডেমির সভায় নিউইয়র্কে আমার দুই প্রিয় লেখক হাসান ফেরদৌস ভাই ও ফেরদৌস সাজেদীন ভাই আলাদা করে আমার কবিতার কথা বললেন। প্রিয় কবি কাজী আতিক ভাই ও প্রিয় লেখক সোনিয়া কাদের আপা সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন।
আমার মতো ভুলোমনা, দিনভর হারানো জিনিস খুঁজে বেড়ানো আর মাঝরাস্তায় গিয়ে কোথায় যাব বুঝতে না পারা দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের জন্য যে কবিতাই আসল জায়গা, সেটা বুঝতে পারলাম জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে। হলুদ পাতা ঝরতে দেখলে, কিংবা ইস্ট রিভারের তীরে প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে অথবা মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিরিবিলি এস্টোরিয়ার বাসায় ঝিঁঝির ডাক শুনতে চাওয়া মানুষের তো একটা আশ্রয় লাগে। যেখানে নিজের দুঃখ কষ্টকে ধুয়ে মুছে সাফ হওয়া যায়। সাহিত্য একাডেমি আমাকে সেই পথের সন্ধান দিয়েছিল। যে কারণে ২০১৮ সালে বইমেলায় প্রকাশিত আমার কবিতার বই- ‘মেয়েটি আজন্ম পতিত থেকে গেল’ উৎসর্গ করেছিলাম সাহিত্য একাডেমি ও তার পরিচালক মোশাররফ হোসেনকে। কারণ সেখানে যাওয়ার পর থেকে আবার আমার কবিতা লেখায় ফেরা।
প্রিয় সংগঠনের শততম আসর পূর্তি উৎসবে রইল শত কোটি শুভেচ্ছা।